নৈতিক শিক্ষার আবশ্যকতা


ই-বার্তা প্রকাশিত: ৬ই নভেম্বর ২০১৭, সোমবার  | সন্ধ্যা ০৬:২০ প্রতিক্রিয়া

সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হলো মানবজাতি। আর এই মানুষের সবচেয়ে মূল্যবান অলংকার হলো তাঁর আখলাক বা চরিত্র। মানুষের মধ্যে সেই ব্যক্তি শ্রেষ্ঠ যে ব্যক্তি উত্তম চরিত্রের অধিকারী আর এটাই মানুষের অহংকার। একজন চরিত্রবান মানুষই পারে তাঁর স্বচ্ছ, নির্মল, সৎ চিন্তাধারা দিয়ে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র চারিদিকেই শান্তির ডানা ছড়িয়ে দিতে। যার আশ্রয়ে কেউ কখনোই অতল গহ্বর ডুবে যাবে না। কিন্তু আমাদের এই সুন্দর চরিত্র গঠনের জন্য যে শিক্ষার প্রয়োজন তার মূল শিক্ষাই হলো নৈতিক শিক্ষা। এই শিক্ষা আমাদেরকে শিষ্টাচার, ভদ্রতা, শালীনতা, মায়ামমতা, ভালোবাসা, সৎ, মানবতার শিক্ষা দেয়, যা কী না একজন আদর্শবান মানুষ এবং একজন সফল মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করে।

জীবনে সফলতার মুখ দেখার জন্য আমাদের প্রচেষ্টা অন্তহীন। কিন্তু এই নৈতিক শিক্ষা ছাড়া তা সম্ভব নয়। এককথায় মানব জীবনকে সুশৃঙ্খল করতে যে শিক্ষার প্রয়োজন সেটাই হলো নৈতিক শিক্ষা। প্রতিটি ধর্মেও মানুষের নৈতিক চরিত্র গঠনের কথা বলা হয়েছে। একটি মানব সন্তান কখনোই কোন পাপ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে না। কিন্তু বড় হয়ে যদি সে কোন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করে থাকে তবে এই নৈতিক শিক্ষার অভাবেই তা সংগঠিত হয়ে থাকে এবং এর জন্য সম্পূর্ণ দায়ী হলো তাঁর পরিবার, আমাদের ঘৃণ্য সমাজ ব্যবস্থা।

জন্ম দিলেই বাবা-মা হওয়া যায় না। শিশুর জন্মের পর বাবা-মায়ের অনেক বেশী দায়িত্ব বেড়ে যায়। একটি গাছের চারাকে যেভাবে যত্ন করে বড় করা হবে, সে গাছটি তেমন সুন্দর ফল দিবে। শিল্পী তাঁর মাটির দলাটিকে যেভাবে গড়বে, সেটি তেমনি আকার ধারণ করবে। জন্মলগ্ন থেকে একটি শিশুকে সুস্থ, সুন্দর, মুক্ত মনমানসিকতায় বেড়ে তোলার দায়িত্ব সম্পূর্ণই বাবা-মায়ের উপর বার্তায়। সন্তান আর বাবা-মায়ের সম্পর্ক যতো মধুর হবে তাঁদের মধ্যে ভালোবাসাও ততো মজবুত হবে।

আবার শিশুটির দিনের অনেকটা সময় কাটে শিক্ষাঙ্গনে। শিক্ষকদের বলা হয়, “মানুষ গড়ার কারিগর”। তাই শিক্ষকদের দায়িত্বও কম নয়। এই ছাত্রদের উত্তম মানুষ গড়ার ক্ষেত্রে তাঁদেরও অবশ্যই একটি বিশেষ বড় ভূমিকা রয়েছে। ভয় নয় বরং বন্ধুসুলভ আচরণই হবে শিক্ষক ছাত্রের সম্পর্ক। শিক্ষা মানেই শুধু জ্ঞানার্জন করে সার্টিফিকেট অর্জন করা না। সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি শিশুদের নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে, বিবেকবোধ জাগ্রত করে তোলার প্রচেষ্টা গ্রহন করতে হবে। যদি কারোর মধ্যে নৈতিক শিক্ষা না থাকে তবে কিভাবে সে সঠিক ও ভুল এবং সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য নির্ণয় করবে? আমাদের সন্তানেরা ভবিষ্যতে সৎ, ভালো অভিভাবক ও সুনাগরিক হয়ে গড়ে উঠবে এটাই সবার প্রত্যাশা। আগামী দিনে তাঁরাই তো দেশ ও জাতির নেতৃত্ব প্রদান করবে। কিন্তু আমাদের শিশুরা এই সঠিক শিক্ষাগুলো কতটুকু পাচ্ছে? বর্তমানে এ নৈতিক শিক্ষা একটি বিরাট প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর যাদের কাছ থেকে এই নৈতিক শিক্ষাগুলো পাবার কথা তাঁরাই বা কতটুকু এই শিক্ষায় শিক্ষিত? যে শিক্ষা মানুষকে সৎ, বিশ্বাসী, চরিত্রবান, আদর্শবান, ভালো মানুষ সৃষ্টি করতে পারে না, নৈতিকতার কোন ছঁটা নেই সে শিক্ষার কী ই বা মূল্য আছ?

একটি শিশু কখনোই ভালমন্দ বিচার করার ক্ষমতা রাখে না। সন্তান যদি নিজ পরিবারে দেখে বাবা-মায়ের সম্পর্কে ফাটল, বাবা দুর্নীতিগ্রস্ত, নেশাগ্রস্ত, অমানবিক কর্মকাণ্ডে জড়িত, মা পরকীয়া, অসামাজিক কাজে লিপ্ত, শিক্ষক রক্ষক না হয়ে যদি হয় ভক্ষক, অশালীন আচরণ করে, তাহলে তো এমন অসুস্থ পরিবেশে বেড়ে উঠে একটি শিশুর ভিতরের মনুষ্যত্ব প্রতিদিনই একটু একটু করে হরণ হয়ে সেও একদিন অসৎ চরিত্রেই পরিণত হবে। ফলে এই সন্তানেরা পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রে বিভিন্ন রকমের বিশৃঙ্খলা, যে কোনো অনৈতিক কার্যকলাপে জড়িয়ে পরতে তাঁর বিবেক জাগ্রতবোধ হবে না। তাইতো অহরহ ঘটে যাচ্ছে একটার পর একটা অপরাধমূলক কাজগুলো। বেড়েই চলেছে দুর্নীতি, ঘুষ, ছিনতাই, প্রতারণা, ধর্ষন, হত্যা। সন্তানের হাতে পিতামাতা, পিতামাতার হাতে সন্তান খুন।এমন কি পিতা কন্যা কে, পুত্র মাতাকে ধর্ষনের মতো জঘন্যতম অপরাধ ও সংঘটিত হচ্ছে। এই অপরাধমূলক কাজগুলো শুধু যে অশিক্ষিত জনেরাই করছে তা কিন্তু নয়, শিক্ষিত উচ্চশিক্ষিতদের দ্বারাও সংঘটিত হচ্ছে। স্কুল,কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কতৃক ছাত্রী, ছাত্র কতৃক শিক্ষিকার শ্লীলতাহানির মতো নিকৃষ্ট ঘটনাও ঘটছে অহরহ। এই পৈশাচিক বর্বরতা থেকে আমাদের কোমলমতি শিশুরাও নিরাপদ নেই। ছাত্র দ্বারা শিক্ষককে লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনাও কম নয়। অথচ অভিভাবক হিসেবে পিতামাতার পরই শিক্ষকের স্হান। এই সবকিছুর পেছনে ঐ একটাই কারণ, তা হলো মানুষের মনুষ্যেতের অভাব আর এই অভাবই হলো তাঁর নৈতিকতার শিক্ষার চরম অভাব।

এখন সবাই যুগের সাথে তাল মিলিয়ে পাপ, পুণ্যের বিচার না করে কে কাকে টেক্কা দিয়ে উপরে উঠবে এই প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে। চাহিদা বাড়ছে দিনের পর দিন। যৌথ পরিবারগুলো তো ভেঙেছে অনেক আগেই । একান্ন পরিবারেও ধরেছে ঘুণ। এই যান্ত্রিক জীবনে সবাই ব্যস্ততার জন্য পরিবারে একে অপরের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। একাকী হয়ে পরছে। ফলে মায়ামমতা, আন্তরিকতা, ভালোবাসা দিনে দিনে হ্রাস পাচ্ছে। অস্থিরতা বাড়ছে, ফলে আমাদের সোনার সন্তানেরা সঠিক যত্নের অভাবে সহজেই পথভ্রষ্ট হয়ে যে কোন অনৈতিকক কাজ এমন কি আত্নহুতির মতো মহা পাপ কাজেও লিপ্ত হয়ে পরছে। এর জন্য সম্পূর্ণ দায়ী আমাদের পরিবার, সমাজ।

আর দেরী নয় আমাদের সন্তানদের আমাদেরই ফিরিয়ে আনতে হবে এই অভিশপ্ত জীবন থেকে। তাই প্রথম পদক্ষেপই নিতে হবে নিজ পরিবার থেকে। অভিভাবকদের সৎ থাকতে হবে। নিজেকে ভালোবাসা, পরিবারে একে অপরের প্রতি সম্মান, স্নেহ, ভালোবাসা শিখাতে হবে। সন্তানদের বাহিরমুখী থেকে ঘরমুখী করাতে হবে। সঠিক রীতিনীতি, আমাদের সংস্কৃতি , ধর্মীয় শিক্ষায় লালন করে শিশুদের গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষাঙ্গন, সমাজ সর্বস্তরে সুশিক্ষার বীজ রোপণ করতে হবে। তবেই আমাদের সন্তানেরা পরিবার, সমাজ, দেশ, দেশের মানুষকে ভালোবাসতে পারবে। ভালমন্দ বিচার করে নিজেরাই ন্যায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে সক্ষম হবে। সুতরাং নৈতিক শিক্ষাই একমাত্র শান্তি এনে দিতে পারে নিজেকে, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে।

মানব কল্যানই হোক ইহলোক ও পরলোকে মুক্তি। এই সত্যটির উপর আস্থা রেখে আমরা যেনো আমাদের চরিত্রকে বটগাছের মতো শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রাখতে পারি। আসুন আমরা সবাই মিলে দূষণমুক্ত সুন্দর পরিপাটি একটি বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তুলি আর মুক্তমনে মুক্ত আকাশে উড়িয়ে দেই এক ঝাঁক শান্তির পায়রা।

- পুনম মায়মুনী

সর্বশেষ সংবাদ

প্রতিক্রিয়া এর আরও সংবাদ