নেলসন ম্যান্ডেলার গান নিয়ে ফকির আলমগীর ও সেজান মাহমুদ মুখোমুখি
বিনোদন ডেস্ক ।। কালো কালো মানুষের দেশে, ঐ কালো মাটিতে/ রক্তের স্রোতের শামিল/ নেলসন ম্যান্ডেলা তুমি অমর কবিতার অন্ত্যমিল/ তোমার চোখেতে দেখি স্বপ্ন-মিছিল/ অগুন্তি মানুষের হৃদয়ের মিল।
পৃথিবীর বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের পুরোধা নেলসন ম্যান্ডেলাকে নিয়ে ১৯৮৯ সালে এই অসাধারণ কথা-সুরের গানটি কণ্ঠে তোলেন দেশের অন্যতম গণসংগীতশিল্পী ফকির আলমগীর। গানটি বেশ জনপ্রিয়তা পায়, এমনকি প্রায় দুই দশক আগে বাংলাদেশ সফরে আসার পর স্বয়ং নেলসন ম্যান্ডেলাও গানটি শুনে মুগ্ধতা প্রকাশ করেন।তবে গানটি তৈরির প্রায় তিন দশক পর চলতি সপ্তাহে এসে নতুন বিতর্কের সৃষ্টি হয়। প্রশ্ন ওঠে এই গানটির গীতিকার-সুরকারের বিষয়ে। অনেকেই এটিকে ফকির আলমগীরের গান বলেই জানেন। বেশিরভাগ মানুষই ধরে নিয়েছেন এটি তার কথা-সুরেই তৈরি। কারণ, এই গানটির গীতিকার কিংবা সুরকার বিষয়ে তেমন কোনও স্পষ্ট তথ্য পাওয়া যাচ্ছিলো না।জানা যায়, এই গানটি লিখেছেন ও প্রাথমিক সুর করেছেন ৮০’র দশকের অন্যতম গীতিকার এবং বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউসিএফ কলেজ অব মেডিসিনের অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিন সেজান মাহমুদ।এ বিষয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বাংলা ট্রিবিউনের কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘যেকোনও গানের রচয়িতার এবং সুরকারের কৃতিত্ব নিয়ে টানাটানি তো গর্হিত কাজ; একেবারে দিনে-দুপুরে ডাকাতির মতো! আমার এই গানটি নিয়ে এতকাল ধরে তাই হচ্ছে।’ তিনি আরও বললেন, ‘আমি গানটি শুধু যে লিখেছি তা-ই না; নেলসন ম্যান্ডেলার মুক্তির দাবিতে স্বাক্ষর সংগ্রহের আন্দোলনের আইডিয়াও আমাদের, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের। তাঁর জন্মদিনে এভাবে অনুষ্ঠান করা, তাকে নিয়ে গান লেখাই শুধু না, মৌলিক সুরটিও করেছিলাম আমি। যা গায়কী এবং লয় পাল্টে একটু ভিন্ন সুরে ফকির আলমগীর পরে গেয়েছেন।
অসংখ্য মানুষ এই ঘটনার সাক্ষী। এখন এ নিয়ে ধোঁয়া তৈরি করাই লজ্জাকর! কণ্ঠশিল্পীর কাজ গান গাওয়া কিন্তু গানটি অন্তরে প্রথমে ধারণ করেন একজন গীতিকবি। এখানে আইডিয়ার সৃজনশীলতাকে সামনে না এনে পুরো ইতিহাসটার কৃতিত্ব নিয়ে অসততা করা শিল্পীসুলভ কাজ না।’এদিকে সেজান মাহমুদের এমন অভিযোগ নিয়ে বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে কথা হলো ফকির আলমগীরের। তিনি অবশ্য বেশ স্পষ্ট করেই বললেন, ‘গানটি লিখেছেন সেজান মাহমুদ। এটা অস্বীকারের সুযোগ নেই।’তার কাছে পাল্টা জিজ্ঞাসা ছিল, গানটির সুরকারও সম্ভবত সেজান মাহমুদ। যদিও কথা-সুরের বিষয়টি আপনার পক্ষ থেকে তেমন স্পষ্ট নয়। টিভি-রেডিও-স্টেজ শো কিংবা পত্রিকার সাক্ষাৎকারেও। মানে আপনার প্রতি সেজান মাহমুদের ভাষ্যটা এমন, ‘গানটির প্রসঙ্গ এলে উনি কায়দা করে আমার নামটি বলেন না!’জবাবে ফকির আলমগীর খানিক হেসে বললেন, ‘আবারও বলি, গানটা সেজান মাহমুদের লেখা। বলাই বাহুল্য সুরটা আমার। দেখুন একটা গান যেকোনও মানুষ লিখতে পারে। কিন্তু সেটাতে সুর দিয়ে রংচং মেখে মানুষের কাছে পৃথিবীর কোনায় কোনায় পৌঁছে দিয়েছে কে? আমি। এই গান আমি দুইবার রেকর্ড করি। একবার চন্দন দত্তের সংগীতায়োজনে আরেকবার বাপ্পা মজুমদারের। এখানে কায়দা করার কোনও বিষয় নেই।’প্রসঙ্গক্রমে তিনি আরও বলেন, ‘অনেকেই আমাকে বলে, ভাই গান গাইতে এসে গীতিকারের নাম এতবার বলেন কেন? এখন দেখি বেশি নাম বলাতেই অপরাধ হয়েছে। আমি গানটাকে সুর দিয়ে কণ্ঠে তুলে সারা বিশ্বে যে ছড়িয়ে দিলাম সেই অবদানকে খাটো করার সুযোগ নাই তো।’চলমান বিতর্ক প্রসঙ্গে গীতিকার সেজান মাহমুদের চূড়ান্ত ভাষ্য এমন, ‘এতদিন পরে এই প্রশ্ন ওঠাটাই অপমানজনক। আমি বরাবরই বলি গানটিকে জনপ্রিয় করার জন্য ফকির আলমগীরের অবদানের কথা। কিন্তু আমার অবদানটার কথাও তিনি বলুক- সেটাই চাই।দেশ আমি তো টাকা পয়সার হিসাব করছি না। মিনিমাম সম্মানটুকু তো পেতে পারি।’‘কালো কালো মানুষের দেশে’:‘কালো কালো মানুষের দেশে’ শিরোনামের আলোচিত এই গানটি তৈরির প্রেক্ষাপট পাওয়া গেল সেজান মাহমুদের একটি লেখায়। সেখানে তিনি লিখেছেন এভাবে, দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলাকে নিয়ে পৃথিবীর অনেকের মতো আমারও এক ধরনের ‘অবসেশন’ আছে। ১৯৮৮ সাল। পৃথিবীব্যাপী নেলসন ম্যান্ডেলার ৭০তম জন্মবার্ষিকী পালনের উদ্যোগ চলছে। তখন আমি স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের দ্বিতীয়বর্ষের ছাত্র। সারাদেশ থেকে নেলসন ম্যান্ডেলার নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে এক লাখ স্বাক্ষর সংগ্রহের আন্দোলনের সঙ্গে আমিও জড়িয়ে গেলাম। এই উপলক্ষে ক্যাম্পাসে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো।
আমার ইচ্ছা নেলসন ম্যান্ডেলাকে নিয়ে গান শিল্পীদের দিয়ে গাওয়ানো। কিন্তু কোথাও কোনও গান না পেয়ে নিজেই দুটো গান লিখে ফেললাম। তখন আমি সবেমাত্র বাংলাদেশ টেলিভিশনে গান লেখা শুরু করেছি। সেই সূত্র ধরে বেশ কয়েকজন কণ্ঠশিল্পীর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে। সামিনা চৌধুরী আমার প্রিয় শিল্পীদের একজন এবং ভালো বন্ধুও বটে। তিনি বিনা পারিশ্রমিকে গাইবার সম্মতি দিলেন।সামিনার গাওয়া গানটির শিরোনাম ‘নেলসন ম্যান্ডেলা, তুমি সবল দুটি হাতে লোহার গারদ ধরে দাঁড়িয়ে আছো’। সেই গানটির সুর করলেন নকিব খান। আর দ্বিতীয় গানটি গাইবার জন্য বললাম গণসংগীতশিল্পী ফকির আলমগীরকে। তিনিও এককথায় রাজি হয়ে গেলেন। কিন্তু তার জন্য লেখা গান ‘কালো কালো মানুষের দেশে…’ গানটির তখনও সুর দেওয়া হয়নি। এদিকে সময়ও কম। আমি নিজেই গানটির সুর দিয়ে পৌঁছে দিলাম তার কাছে। সেদিন মিটফোর্ডের হলভর্তি মানুষকে মুগ্ধ করলেন এই শিল্পীদ্বয়। ফকির আলমগীর মিটফোর্ডের গণ্ডি পেরিয়ে বাংলা একাডেমি বইমেলা, জনতার মঞ্চ ছাড়িয়ে সারা বিশ্বে বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যে পৌঁছে দিলেন গানটি। এমনকি গানটির একটি ক্যাসেট খোদ নেলসন ম্যান্ডেলাকেও পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল।
ই-বার্তা ।। ডেস্ক