বিদ্বেষ ছড়িয়ে কাউকে বাদ দেওয়ার দাবি তোলা ঠিক নয়ঃ শিক্ষক নেটওয়ার্ক

ই-বার্তা  ।।  জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও পরিমার্জনে শিক্ষামন্ত্রণালয়ের গঠিত সমন্বয় কমিটিতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের দুই সদস্যের থাকা নিয়ে বিতর্কে শিক্ষক নেটওয়ার্ক বলেছে, ‘যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে, তবে বিদ্বেষ ছড়িয়ে কাউকে বাদ দেওয়ার দাবি তোলা ঠিক নয়।

শনিবার সকাল ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে ‘দেশের সার্বিক পরিস্থিতি, অসহিষ্ণুতা, ঘৃণা ও বিদ্বেষী আচরণের বিষয়ে সরকারের নীতির অস্পষ্টতা প্রসঙ্গে’—শীর্ষক একটি স্মারকলিপি প্রধান উপদেষ্টার কাছে পাঠানোর বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে করে শিক্ষক নেটওয়ার্ক।

সংবাদ সম্মেলনে স্মারকলিপিটি পড়ে শোনান শিক্ষক নেটওয়ার্কের সদস্য অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন এবং সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন অন্য সদস্যরা। স্মারকলিপিটির অনুলিপি স্বরাষ্ট্র, শিক্ষা, আইন, ধর্ম ও প্রতিরক্ষা উপদেষ্টার কাছেও পাঠানো হবে বলে জানানো হয়।

এনসিটিবির কমিটিতে অ্যাক্টিভিস্ট রাখাল রাহা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন ও সমাজবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফাসহ ১০ জনকে নেওয়া হয়েছে। শুক্রবার এটিকে ইঙ্গিত করে শায়েখ আহমদুল্লাহ এক ফেসবুক পোস্টে লিখেন, ‘ধর্মপ্রাণ মানুষের সন্তানরা কী পড়বে তা ঠিক করবে চিহ্নিত ধর্ম বিদ্বেষীরা। এটা শহীদদের রক্তের সঙ্গে সুস্পষ্ট বেঈমানি।’

সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক রুশাদ ফরিদী বলেন, পাঠ্যপুস্তকের কমিটিতে থাকার বিষয়ে যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে তবে বিদ্বেষ ছড়িয়ে কাউকে বাদ দেওয়ার দাবি তোলা ঠিক নয়।

তিনি বলেন, বিদ্বেষমূলক ট্যাগ দেওয়া, ইসলামবিদ্বেষী বা ধর্মবিদ্বেষী বলে তাদেরকে বাদ দিতে হবে এই ধরনের দাবি সমাজে অস্থিরতা তৈরি করে, সংঘাত তৈরি করে এবং করছে। আমরা স্বৈরাচারী আমল থেকে বের এসে হয়ে নতুন সমাজ গঠন করছি তখন এই অস্থিরতা, বিদ্বেষ দেখতে চাই না। সেজন্য আমাদের এ স্মারকলিপি পাঠানো।

রুশাদ ফরিদী আরও বলেন, আজকে সামিনা লুৎফার এখানে থাকার কথা নয়। তিনি বাকৃবিতে অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার কথা। উনি সেখানে বড় হয়েছেন। তার বাবা মা সেখানে থাকেন। অথচ সেখানে তিনি যেতে পারলেন না। ওনাকে হুমকি দেওয়া হয়েছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাইফ ফেরদৌস বলেন, যে রেজিম বিদায় নিয়েছে, তাদের অনেকে ফৌজদারী ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয়। যারা জড়িত তাদের প্রতিও প্রতিহিংসা নয়, আমরা ন্যায়বিচার চাই। সমাজ সব রকমের মানুষ আছে; নন বাইনারি মানুষ আছে, তাদেরকে কি দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেব? এটা তো ঠিক হতে পারে না। যে কোনো বিষয়ে অন্যের অধিকারকে সংকুচিত না করে যৌক্তিকভাবে বলা যেতে পারে।

প্রধান উপদেষ্টা বরাবর পাঠানো স্মারকলিপিতে বলা হয়, অভ্যুত্থানের মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই বাংলাদেশের নানা প্রান্তে বিভিন্ন ধরনের অসহিষ্ণু, আক্রমণাত্মক ও নৈরাজ্যবাদী জমায়েত আমরা লক্ষ করছি। সেসব জমায়েত থেকে অপছন্দের গোষ্ঠী ও দলের বিরুদ্ধে কেবল হিংসাত্মক কথাবার্তাই বলা হচ্ছে না, ক্ষেত্রবিশেষে সেসব মানুষের ওপর হামলাও চালানো হচ্ছে।

এতে উল্লেখ করা হয়, তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘবদ্ধ হিংস্রতায় নিহত হয়েছেন তিনজন মানুষ। অপরাধীদের ধরতে গিয়ে একজন সেনা কর্মকর্তা হামলায় নিহত হয়েছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে ভিন্ন জাতিসত্তার মানুষকে। মাজার, মন্দির, শিল্প- স্থাপনা ভাংচুর থেকে শুরু করে বাউল ও আহমেদিয়াদের ওপরও আক্রমণ হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে নাগরিকদের নিরাপত্তাবোধের অভাব তীব্রতর হবে এবং সংকট উত্তরণে সরকারকে আরও বেগ পেতে হবে।

স্মারকলিপিতে আরও বলা হয়, অতি উৎসাহী গোষ্ঠীগুলোর অসহিষ্ণুতা প্রশমণের জন্য যারা এ সব ঘৃণামূলক বক্তব্য প্রচার করছেন এবং বিভিন্ন পরিচয় ও সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর বা নাগরিকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করছেন তাদের থামাতে হবে।

তারা আরও উল্লেখ করেন, সরকারের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট ঘোষণা আসতে হবে, তারা আসলে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ কীভাবে নিশ্চিত করবেন এবং সহিংস জমায়েতের সংঘবদ্ধ হিংস্রতা থেকে ভিন্ন মত বা সম্প্রদায়ের মানুষের অধিকার রক্ষায় কী কী পদক্ষেপ নেবেন।

গীতি আরা নাসরীন বলেন, আমরা মনে করি এটি সবারই কথা। তাই এটি জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়েছে এবং আজ বা কালকের মধ্যে উপদেষ্টার কাছে পাঠানো হবে। যে ঘটনাগুলো ঘটছে এগুলো যে গ্রহণযোগ্য নয় এ ব্যাপারে আমরা নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে পরিষ্কার বার্তা চাচ্ছি।

সংবাদ সম্মেলনে অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন, সামিনা লুৎফা, ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তাসনীম সিরাজ মাহবুব, নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক জোবাইদা নাসরীন, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের কাজলী সেহরীন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।