আমরা কি আর একটি যুদ্ধে জিততে পারি না?

ই-বার্তা ।।  কেউ বসে, কেউ দাড়িয়ে, সবাই কাঁদছে হাউ মাউ করে। কান্নার শব্দে ছোট্র বাড়ির চারপাশের বাতাস ভারি হয়ে গেছে। শোবার ঘরের সামনের জলচকিতে বাবার লাশ সাদা কাফনে ঢাকা। একটু দূরের বারান্দায় মায়ের চোখে শুধু অঝোরে জল ঝরছে, মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না। বাবার অসুস্থতার খবর পেয়ে এসে, এ দৃশ্য দেখার পর বুকের ভেতর সমুদ্রের ঢেউ আছরে পড়ছে, কাঁচের মত হৃদয় ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। পুরো শরীর অবেশ, দুই হাত দিয়ে মাথা ধরে বাবার লাশের সামনে হাটুগেড়ে বসে পড়েছে ছেলে, পৃথিবী যেন থমকে গেছে তখন!

প্রিয়জন হারানো এ কঠিন তীব্র বেদনার সময়ের কথা মনে পড়ে, অনেকের চোখে হয়তো পানি চলে আসবে। কারণ, এ চিত্র আমাদের গ্রামের, বাংলার ও বাঙালীর, এ সত্য আমাদের জীবন ও মৃত্যুর। এ কান্নার গল্প আমাদের পরিবারের।

কিন্তু, যদি ভিন্নরকম হয়। বাবা, মা, ভাই, বোন অথবা কলিজার টুকরা সন্তান মারা গেছে। দাফন তো দূরের কথা প্রিয়মুখটা একবার দেখারও সুযোগ নেই। তবে, এই বাংলায়, এর থেকে বড় হাহাকার আর কি হবে? বেঁচে থেকেও কি জীবন্ত মনে হবে ছেলে হারা বাবার, ভাই হারা বোনের?

রূপকথার গল্প বলছি না, করোনা ভাইরাসে আক্রান্তে বাবার মৃত্যুর পরে জানাজা করতে না পেরে ছেলে ফেসবুকে যে হৃদয়বিদারক পোস্ট দিয়েছিলেন তা মিডিয়ার কল্যাণে দৃশ্যমান হয়েছে দেশ ও পৃথিবীজুড়ে।
নোভেল করোনাভাইরাস বা কোভিড নাইনন্টিন। চীনের উহান থেকে শুরু করে আজ বিশ্বজুড়ে, যার আক্রমণে শুরু হয়েছে মৃত্যুর মিছিল। এতই ভয়বহতা এই ভাইরাসের, যে কে বাবা, কে মা, কে ভাই, কে বোন, কে প্রিয়জন কিছুই বোঝেনা, কাউকেই চেনেনা। শুধু একজন থেকে আরেকজনের শরীর আক্রান্ত হতে থাকে, ফেলে দেয় মৃত্যুযন্ত্রনায়। সেই মরণঘাতি ভাইরাস বিদেশ হয়ে এখন ছড়িয়ে পড়েছে সোনার বাংলায়। যার কোনো টিকা এখনও আবিস্কার হয়নি। শুধু সচেতনতা ও সতর্কতাই পারে এখন এই মরণঘাতক থেকে বাাঁচাতে।

বাংলাদেশের সরকার দেশের মানুষকে এই ভাইরাস থেকে রক্ষা করতে, বাঁচাতে বিভিন্ন জরুরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। সরকারি বেসরকারি সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস ও আদালত নিদিষ্ট সময়ের জন্য ছুটি ঘোষণা করেছেন, নৌ, স্থল, জল ও আকাশ পথে চলাচল বন্ধ করে দিয়েছেন। ঔষুধ, কাঁচাবাজার ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রবাদির দোকান বাদে সব বন্ধ করে দিয়েছেন। স্থানীয় প্রসাশন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে কাজ করার জন্য নামিয়েছেন সেনাবাহিনী। সরকারী ও বেসসরকারী তহবিলের মাধ্যমে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য করেছেন আহারের ব্যবস্থ। কিন্তু, কেন? সতর্কতা,সচেতনতা ও প্রয়োজনীয় প্রতিরোধী ব্যবস্থার মাধ্যমে করোনা ভাইরাসকে প্রতিরোধ করতে ও এর সংক্রমণ থেকে দেশের মানুষকে বাাঁচাতে, তাই নয় কি?

নাটোর জেলার বেশ কিছু পয়েন্ট আজ ঘুরে মনে হলো, আমরা সত্যি কি আমাদের ভালবাসি, ভালবাসি আমাদের প্রিয়জনদের, ভাল কি বাসি বাবা, মা, ভাই, বোন ও প্রিয় সন্তানকে? যদি ভালোইবাসি, কোথায় আমাদের সচেতনতা, কোথায় আমাদের সতর্কতা? নাকি অসরর্কতায়, আমরা নিজেদের অজান্তেই যোগ দিতে যাচ্ছি মৃত্যুর মিছিলে!

আমরা তো বাঙালি জাতি, যাদের হৃদয়ে আছে অসীম সাহস আর গভীর ভালোবাসা। নিজের প্রিয়জনের জন্য কি আমরা আর একবার খুলতে পারিনা সেই ভালোবাসার দুয়ার?

নিজের জন্যও কি করোনো ভাইরাস প্রতিরোধে ঘরে থাকতে পারি না? সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখতে পারিনা নিজের সন্তানের জন্য? দেশের ও দেশের মানুষের জন্য কি একটু সাবান অথবা স্যানিটাইজার দিয়ে হাত বার বার পরিস্কার করতে পারিনা? আমাদের মা কে বাঁচাতে, পরতে পারিনা মাস্ক? আমরা কি পারি না বিশেষ প্রয়োজন ব্যাতিত বাইরে যাওয়া বন্ধ করতে?

আজ থেকে ৪৯ বছর আগে আমরাই তো পেরেছিলাম। হাতে হাত রেখে, কাঁধে কাঁধ মিলেয়ে, বুকের রক্ত মাটিতে বিলিয়ে ছিনিয়ে এনেছিলাম বাংলাদেশ নামের নতুন এক সূর্য।

জয়ের নেশা তো আমাদের রক্তে, স্বাধীনতার এই দিনে আবার সবাই মিলে কি আর একটি যুদ্ধ করতে পারি না? প্রিয়জনকে বাঁচাতে, আমরা কি জিততে পারিনা…ঘরে থাকার যুদ্ধে, দূরে থাকার যুদ্ধে?

লেখকঃ তারিকুল হাসান,সম্পাদক, ই-বার্তা