একনজরে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল

ই-বার্তা ডেস্ক ।।   বিখ্যাত সুরকার, গীতিকার ও সংগীত পরিচালক আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল সুরের মায়া কাটিয়ে চিরবিদায় নিয়েছেন।

সংগীত জগতে দীর্ঘ চার দশকের ক্যারিয়ার ছিল তার। এ সময়ে দুই শতাধিক চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা করেছেন তিনি।

১৯৫৬ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। সত্তরের দশকের শেষ সময় থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চলচ্চিত্র শিল্পসহ সংগীতে সক্রিয় ছিলেন তিনি। একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পদক ও রাষ্ট্রীয় পদকসহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন এ বরেণ্য সুরকার।

 

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল মাত্র ১৫ বছর। বুলবুল তখন ঢাকার আজিমপুরের ওয়েস্টটেন্ট হাইস্কুলের ছাত্র।

কিন্তু কিশোর বয়স হলেও ঘরে বসে থাকেননি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অংশ নিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে। রাজাকার ও পাকবাহিনীর নির্মম নির্যাতনের শিকারও হয়েছিলেন তিনি।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযমের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন বুলবুল। তখন সেই সময়ের ঘটনাবলি তুলে ধরেছিলেন তিনি।

বুলবুল ও তার কয়েক বন্ধু ২৫ মার্চ রাতের গণহত্যা দেখার পর যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। প্রথমে বিহারিদের বাসা থেকে অস্ত্র ছিনতাই করে ছোট একটি মুক্তিযোদ্ধা বাহিনী গঠন করেন। পরে জিঞ্জিরায় মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি গড়ে তোলেন তারা।

পাকিস্তানি বাহিনীর হামলায় টিকতে না পেরে সেখান থেকে ঢাকায় চলে আসেন বুলবুল। জানতে পারেন বড় ভাই ইফতেখার উদ্দিন আহমেদ টুলটুল মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা দল ক্র্যাক প্লাটুনে যোগ দিয়েছেন।

পরে বড় ভাইয়ের কাছ থেকে পাওয়া গ্রেনেড নিয়ে জুলাই মাসের মাঝামাঝিতে নিউমার্কেটের ১ নম্বর ফটকে পাকিস্তানি বাহিনীর লরিতে আক্রমণ করেন বুলবুল ও তার বন্ধু সরোয়ার।

ভারতে গিয়ে আগস্টে একদফা প্রশিক্ষণ নিয়ে আসেন। তার পর ঢাকার লালবাগ এলাকায় কাজ শুরু করেন বুলবুল ও তার বন্ধু সজীব।

তাদের প্লাটুনকে বলা হতো ওয়াই (ইয়াং) প্লাটুন। অক্টোবরে রমজানে ফের ভারতে যাওয়ার সময় কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাঝামাঝি তন্তর চেকপোস্টে পাকিস্তানি বাহিনী এবং রাজাকারদের হাতে বন্দি হন তিনিসহ চারজন।

নির্মম নির্যাতনের পর তাদের নগ্ন অবস্থায় বাসে করে নিয়ে যাওয়া হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগারে। সেখানে অন্তত ৫৫ মুক্তিযোদ্ধাকে বন্দি রেখেছিল পাকবাহিনী।

রোজার ঈদের দিন সন্ধ্যায় ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় পুলিশ কর্মকর্তা ছিরু ও তার ছেলেসহ ৩৯ জনকে আলাদা করে জেল থেকে বের করে এনে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা। তাদের মধ্যে একজন প্রাণে বেঁচে যান।

দুদিন পর বুলবুলসহ চার বন্ধুকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শান্তি কমিটির অফিস দানা মিয়ার বাড়িতে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। সেই রাতেই সেখান থেকে পালিয়ে যান বুলবুলরা।

বুলবুল ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেন ২০১২ সালের আগস্টে। পরের বছর খুন হন তার ছোট ভাই আহমেদ মিরাজ। ২০১৩ সালের ৯ মার্চ রাতে কুড়িল ফ্লাইওভারের পাশ থেকে পুলিশ মিরাজের লাশ উদ্ধার করে।

সেই ঘটনার বিচার না পাওয়ায় হতাশা ছিল বুলবুলের মনে।

তিনি চলচ্চিত্র সংগীত পরিচালনায় আসেন ১৯৭৮ সালে ‘মেঘ বিজলী বাদল’ সিনেমা দিয়ে। এর পর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সংগীত সাধনা থেকে একচুল সরে যাননি বুলবুল।

১৯৮৪ সালে নয়নের আলো চলচ্চিত্রের সংগীতায়োজন করেন বুলবুল। পরিচালনায় ছিলেন বেলাল আহমেদ। ওই সিনেমার জন্য লেখা তার বেশ কয়েকটি গান তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। সেগুলো হচ্ছে- ‘আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি’, ‘আমার বাবার মুখে’, ‘আমার বুকের মধ্যেখানে’, ‘আমি তোমার দুটি চোখের দুটি তারা হয়ে’।

এর পরের ৪০ বছরে মরণের পরে, আম্মাজান, প্রেমের তাজমহল, অন্ধ প্রেম, রাঙ্গাবউ, প্রাণের চেয়ে প্রিয়, পড়ে না চোখের পলক, তোমাকে চাই, লাভ স্টোরি, ভুলোনা আমায়, আজ গায়েহলুদ, লাভ ইন থাইল্যান্ড, আন্দোলন, মন মানে না, জীবন ধারা, সাথী তুমি কার, হুলিয়া, অবুঝ দুটি মন, লক্ষ্মীর সংসার, মাতৃভূমি, মাটির ঠিকানাসহ দুশ শতাধিক চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা করেন বুলবুল।

তবে শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালকের জাতীয় পুরস্কার পান ২০০১ সালে এবং হাজার বছর ধরে সিনেমার জন্য ২০০৫ সালে। আর সংগীত জগতে অনবদ্য আবদানের জন্য ২০১০ সালে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলকে একুশে পদক দেয় সরকার।

তবে কেবল চলচ্চিত্রের জন্য সংগীত পরিচালনাই নয়, দেশের সমকালীন শিল্পীদের নিয়েও কাজ করেছেন তিনি।

সাবিনা ইয়াসমিন, রুনা লায়লা, সৈয়দ আব্দুল হাদি, এন্ড্রু কিশোর, সামিনা চৌধুরী, খালিদ হাসান মিলু, আগুন, কনকচাঁপাসহ বহু জনপ্রিয় সংগীতশিল্পীদের নিয়ে কাজ করেছেন তিনি।

 

ই-বার্তা /  তামান্না আলী প্রিয়া