কখনো এএসপি কখনো ম্যাজিস্ট্রেট

ই-বার্তা ।।  মালয়েশিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ করছেন মুনিরা বেগম (ছদ্মনাম)। লম্বা ছুটিতে দেশে এসেছেন। বাবা-মাসহ ভারতে বেড়াতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। গুলশানে হাইকমিশনার কার্যালয়ে ভিসার জন্য গিয়ে পরিচয় হয় চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হুমায়ুন কবির মাহমুদের সঙ্গে। হুমায়ুন কবির মাহমুদও ভারত যাবেন বিশেষ প্রয়োজনে। ফোন নম্বর বিনিময়ের পর সেদিন দুজন বিদায় নেন। পরে তাদের মধ্যে ফোনে ঘনিষ্ঠতা হয়।

হুমায়ুন কবির মাহমুদ নিজের সম্পর্কে বিস্তারিত জানান মুনিরার কাছে। তার বাবা ডা. মুবিন খান। কুমিল্লায় তাদের বাড়ি। কুমিল্লার একজন মন্ত্রী তার আপন চাচা। ফিজিক্যালি আনফিট দেখিয়ে কবির জার্মানে থাকেন। সেখানে ল বিষয়ে পিএইচডি করছেন। তার দুই বোন জার্মানিতে ও এক ভাই আমেরিকায় থাকেন বলে মুনিরাকে জানান কবির। এত বড় ঘরের যোগ্য সন্তানের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে বলে নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করেন মুনিরা। মুনিরার বাসা ঢাকার মগবাজারে।

তার বাবা একজন ব্যাংকার। মুনিরা ও কবিরের মধ্যে ফোনে কথা হয় নিয়মিত। সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যান কবির। তাদের মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। দুজন দুজনকে ভালোবাসেন। একপর্যায়ে মুনিরার মায়ের সঙ্গে কথা বলতে চান। বিয়ের প্রস্তাব দেবেন তিনি। মুনিরার কাছে ‘প্রতিষ্ঠিত’ ছেলের পরিচয় জেনেই মুগ্ধ মুনিরার মা। কবির নিয়মিত মুনিরাদের বাসায় যাতায়াত করতেন।

হঠাৎ কবির বলেন, তার বাবা ডা. মুবিন খান মারা গেছেন। এখন তিনি এতিম। বিয়ের প্রস্তাব দেন। পরে আনুষ্ঠানিকতা হবে জানিয়ে কয়েক দিন পরই মুনিরাকে বিয়ে করেন। বিয়ের পাঁচ দিন পরই নানা সমস্যার কথা বলতে থাকেন কবির। মুনিরার বাবা তার ডিপোজিট ভেঙে ৬ লাখ টাকা দেন। কবিরের কথামতো ব্র্যাক ব্যাংকের মতিঝিল শাখায় টাকা জমা দেন মুনিরা। টাকা অ্যাকাউন্টে যাওয়ার পরই কবির জার্মানি যাবেন বলে মুনিরাকে জানান। ১২ দিন পর ফিরে আসেন কবির। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খবরটা প্রথম পান মুনিরা বেগম। বিশ্বাস করেননি শুরুতে।

যদিও খবর শুনেই মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে তার। মুনিরা আর কবিরের যৌথ ছবি দেখে সোহেল নামে একজন মুনিরার কাছে জানতে চান, লোকটি কে? মুনিরা জানান তিনি তার স্বামী। সোহেল তখন তাকে বলেন, এই লোকটি তার মামাতো বোনকে বিয়ে করেছেন কয়েক দিন আগে। তিনি একজন পুলিশের এএসপি। তখন মুনিরা জানান, ও তো ম্যাজিস্ট্রেট। এএসপি কেন হবে? এসব কথোপকথনের মধ্যেই সন্দেহ হতে থাকে কবিরের বিষয়ে। তিনি সবার সঙ্গে পরামর্শ করে পুলিশকে জানান। পুলিশ তদন্ত শুরু করে।

প্রতারণার শিকার দুই তরুণীর পরিবারের মধ্যে জানাজানির পর বড় মগবাজারের ডাক্তার গলির বাসায় গেলে কবিরকে গ্রেফতার করে রমনা থানা পুলিশ। এ ঘটনায় মুনিরা বাদী হয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন। মুনিরা বেগম পুলিশকে জানান, জার্মানি চলে যাচ্ছি বলে বিদায় নিতেন কবির। এভাবে প্রায়ই জার্মানি চলে যাচ্ছি বলে বিদায় নিতেন। আবার সপ্তাহ-দশ দিন পর ফিরে আসতেন। কবিরের পরিবারের কেউ তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন না। এসব নানা কারণেই সন্দেহ হয় মুনিরার স্বজনদের। এসব ক্ষেত্রে নানা কৌশল অবলম্বন করতেন কবির। মুনিরা বলেন, বোঝার কোনো উপায় ছিল না যে সে প্রতারক। কারণ, অনেক পুলিশ কর্মকর্তা তাকে ‘স্যার স্যার’ বলে সম্বোধন করতেন।

এ বিষয়ে গাজীপুরের টঙ্গীর সাতাইশ এলাকার শাহ? আলম জানান, এএসপি পরিচয় দিয়ে তার আত্মীয়ের মেয়েকে বিয়ে করেন এই প্রতারক। বিমানবন্দর এলাকায় তার রেন্ট-এ কারের ব্যবসা রয়েছে। রেন্ট-এ কার ব্যবসায়ী শাহজাহান, নূর ইসলামের মাধ্যমে তাকে চেনেন তারা। অনেক পুলিশ কর্মকর্তাও তাকে স্যার বলে সম্বোধন করেন, যে কারণে তাদের কোনো সন্দেহ হয়নি। পুলিশ জানায়, পুলিশের জেরায় সব স্বীকার করেছেন কবির। পুলিশের অনেক সদস্যকেও তিনি এসব পরিচয় দিতেন। সহজে কোথাও ধরা পড়েননি। তিনি দেশে থেকেই ফোনে কথা বলে জানাতেন বিদেশে আছেন।

তার বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ রয়েছে বলে জানা গেছে। আসাদুজ্জামান মামুন নামে তার একটি মোটর ড্রাইভিং লাইসেন্স রয়েছে। একাধিক গাড়ি ও বিভিন্ন ব্যাংকে তার অ্যাকাউন্ট রয়েছে। হুমায়ুন কবির মাহমুদ আলম কবির ওরফে মাসুদের বাড়ি কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার হামিরাবাগ গ্রামে। তার বাবার নাম আবদুল জব্বার লতু মিয়া। পুলিশ জানায়, তিনি কখনো সহকারী পুলিশ কমিশনার বা একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের রূপ ধারণ করতেন। আর যখন তিনি এই দুই রূপ ধারণ করতেন তখন কেউই বুঝতে পারতেন না যে তিনি আসলে পুলিশ কমিশনার, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কিছুই নন। তবে তার আসল পরিচয় তিনি একজন ভয়ঙ্কর প্রতারক। কখনো সহকারী পুলিশ কমিশনার, কখনো নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট— এ রকম নানা পরিচয়।

মিথ্যা পরিচয় দিয়ে একের পর এক বিয়ে করে অর্থ-সম্পদ হাতিয়ে নেওয়াই তার কাজ। সহজ-সরল মানুষ সহজেই প্রতারণার শিকার হয়েছেন তার। এমনকি পুলিশের অনেক কর্মকর্তাও জানতেন না তার প্রতারণার বিষয়টি। যে কারণে পুলিশের কিছু কর্মকর্তার সঙ্গে ছিল তার বন্ধুত্ব। জুনিয়রদের অনেকে তাকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ওয়াকিটকি টেবিলে রেখে চেয়ারে বসে ছবি শেয়ার করেছেন তিনি। এসব দৃশ্য দেখে আন্দাজ করার উপায় নেই এ সবই মিথ্যা। সত্য হলো তিনি একজন প্রতারক।

রিমান্ডে পুলিশকে দেওয়া কবিরের প্রতারণার অভিনব গল্প শুনে অবাক পুলিশ কর্মকর্তারা। কুমিল্লার একটি কলেজে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন কবির। পরে গাড়ির ড্রাইভিং শিখে ঢাকায় কাজ করতেন। পুলিশের ডিউটিতেও ব্যবহার হতো তার গাড়ি। এ ছাড়া প্রশাসনের কয়েকজন কর্মকর্তার গাড়ি চালিয়েছেন কবির। ওই সময় থেকেই পুলিশ কর্মকর্তা ও ম্যাজিস্ট্রেটদের আচরণ রপ্ত করেছেন। পুলিশের কাছে স্বীকার করেছেন, পাঁচ বছর ধরে প্রতারণা করে যাচ্ছেন। তবে তদন্ত কর্মকর্তার ধারণা, তার চেয়ে বেশি সময় ধরে প্রতারণা করছেন তিনি।

পুলিশ জানায়, কবিরের মতো প্রতারক চক্রের সদস্যরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। সাধারণ মানুষ অসচেতনতার কারণে এদের খপ্পরে পড়ছে।