কৃত্রিম কিডনি তৈরি করলেন বাঙ্গালী বিজ্ঞানী শুভ রায়

ই-বার্তা ডেস্ক ।।  আধুনিক জীবন, জেটগতির লাইফস্টাইল। ফাস্টফুডের প্রতি তীব্র ভালোবাসা। পরিণতি, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীর রোগের ডিপো।

বারোটা বাজছে হার্ট, ফুসফুস, লিভার, কিডনির। ক্রনিক হচ্ছে কিডনির রোগ। ডায়ালিসিসের জন্য হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। যদি নষ্ট হয়ে যায় কিডনি? সমাধানের একটাই রাস্তা। কিডনি প্রতিস্থাপন।

কিন্তু খরচের ভয়ে পিছিয়ে আসছেন? এবার হাতের কাছেই মুশকিল আসান। বাঙালি বিজ্ঞানী শুভ রায় ওই সমস্ত সমস্যা সমাধানে কৃত্রিম কিডনি তৈরি করে ফেলেছেন। খুব শিগগিরই বাজারে আসছে এই কৃত্রিম কিডনি। আকারে হাতের মুঠোর সমান। খরচ তুলনায় অনেকটাই কম। ২০১৯-এর মধ্যেই বাজারে আসার সম্ভাবনা এই কৃত্রিম কিডনির।

ইতিমধ্যে, এই আবিষ্কারের কার্যকারিতা পরীক্ষা করেছেন শুভ রায়। তিনি আশা করছেন, কয়েক বছরের মধ্যে এই কিডনি মানবদেহে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হবে। তবে এ জন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষার আগে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমতি দরকার। আপাতত সেই অনুমতির অপেক্ষায় আছে শুভ রায়ের দল।

এ প্রসঙ্গে সংবাদ সম্মেলনে শুভ জানান, ১০ বছর আগে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪০ জন সহকর্মীকে নিয়ে কৃত্রিম কিডনি তৈরির কাজ শুরু করেন তারা। এই প্রকল্প সফল হলে মানবদেহের জন্য প্রয়োজনীয় কিডনির চাহিদা অনেকটাই পূরণ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

শুভর এই আবিষ্কারের খবর ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে প্রকাশিত জার্নাল ‘টেকনোলজি রিভিউ’তে ছাপা হয়েছে। এ ছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যমে এই খবর ফলাও করে প্রচার করা হয়।

কিন্তু কিছু গণমাধ্যমে শুভকে ‘ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক’ উল্লেখ করায় খানিকটা চটেছেন এই বাংলাদেশি বিজ্ঞানী। পড়াশোনা এবং কর্মজীবনে আমেরিকায় স্থায়ী হলেও মনেপ্রাণে নিজেকে বাংলাদেশি হিসেবেই গর্ববোধ করেন এই বিজ্ঞানী।

শুভ বলেন, ‘আমি বাংলাদেশের ছেলে। বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে গেছি। আমাকে কেন ভারতীয় হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে, এটা নিয়ে আমি বিব্রত।’ উল্লেখ্য, বাংলাদেশের চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন শুভ। উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দিয়েছিলেন। এর আগে বাবার কর্মক্ষেত্রের সুবাদে উগান্ডায় বসবাস করেন অনেকদিন।

চলছে পরীক্ষা-নিরীক্ষা

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক কৃত্রিম কিডনির সহ-আবিষ্কারক শুভ রায় জানান, আমেরিকায় তৈরি এই যন্ত্র আপাতত সেদেশের কয়েক হাজার রোগীর দেহে পরীক্ষামূলকভাবে বসানো হয়েছে। শারীরিক সুরক্ষা ও সর্বাঙ্গীন সাফল্যের পরীক্ষায় উতরালে তা বাজারে ছাড়ার অনুমতি দেবে মার্কিন খাদ্য ও ওষুধ নিয়ন্ত্রক এফডিএ।

যেভাবে কাজ করে কৃত্রিম কিডনি

এর উত্তরে শুভ রায় বলেন, যন্ত্রটি সহজেই পেটের ভিতরে স্থাপন করা যায়। স্বাভাবিক কিডনির মতো রক্ত শোধন করা ছাড়াও হরমোন উৎপাদন ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। সাধারণ হিমোডায়ালিসিস প্রক্রিয়ার মতো রক্ত থেকে বিষাক্ত বর্জ্য বাদ দেওয়া ছাড়াও জীবন্ত কিডনি কোষ দিয়ে তৈরি বায়ো রিঅ্যাক্টর এবং সূক্ষ্ম পর্দার মাধ্যমে রক্ত শোধনের কাজ নিখুঁতভাবে করতে পারে কৃত্রিম কিডনি।

কম খরচ

কিডনি সমস্যায় বাংলাদেশে প্রতি বছর অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস এবং হাই ব্লাড প্রেশারই তার অন্যতম কারণ। কিডনির ক্রনিক সমস্যা সমাধানে ডায়ালাইসিস বা কিডনি প্রতিস্থাপনের খরচ অনেক।

কৃত্রিম কিডনির সঠিক খরচের হিসাব এখনই না বললেও শুভ রায়ের দাবি, ডায়ালাইসিস ও কিডনি প্রতিস্থাপনের চেয়ে অনেক কম খরচে বসানো যাবে কৃত্রিম কিডনি।

শৈশব

শুভ রায় ১৯৬৯ সালের ১০ নভেম্বর ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক নিবাস চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি উপজেলার রোসাংগিরিতে। তার বাবা চিকিৎসক অশোক নাথ রায় চট্টগ্রামের আশকারদীঘির উত্তর পাড়ের মাউন্ট হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। মা রত্না রায় গৃহিণী।

শিক্ষাজীবন

পাঁচ বছর বয়সে ঢাকায় সিদ্ধেশ্বরীর একটি বিদ্যালয়ে নার্সারিতে শুভ রায়কে ভর্তি করানো হয়েছিল। কিন্তু তার বাবা অশোক নাথ রায়ের পেশাগত কারণে ১৯৭৪ সালে তাদের উগান্ডায় চলে যেতে হয়। সেখানে অশোক নাথ রায় চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেন। উগান্ডার জিনজা সিনিয়র সেকেন্ডারি স্কুল থেকে সেকেন্ডারি পাস করেন শুভ রায়। এরপর যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান।

কম্পিউটার বিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান ও গণিতে গ্র্যাজুয়েশন করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইওর মাউন্ট ইউনিয়ন কলেজ বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অব মাউন্ট ইউনিয়নে। ১৯৯৫ সালে কেস ওয়েস্টার্ন রিজার্ভ ইউনিভার্সিটি থেকে তড়িৎ কৌশল ও ফলিত পদার্থবিজ্ঞানে মাস্টার্স এবং ২০০১-এ তড়িৎ প্রকৌশল ও কম্পিউটার বিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

কর্মজীবন

১৯৯৮ সালে তিনি ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে প্রজেক্ট স্টাফ হিসেবে যোগ দেন। ১৯৯৮ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের বায়োমাইক্রো ইলেক্ট্রো মেকানিক্যাল সিস্টেমস ল্যাবরেটরির সহ-পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। ২০০০ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত তিনি ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের স্পাইন রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে কাজ করেন।

২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ক্লিভল্যান্ড স্টেট ইউনিভার্সিটির ফলিত বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং প্রোগ্রামের সহকারী অধ্যাপক এবং কেস ওয়েস্টার্ন রিজার্ভ ইউনিভার্সিটির তড়িৎ প্রকৌশল ও কম্পিউটার বিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২০০২ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত তিনি ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী স্টাফ হিসেবে কাজ করেন।

২০০৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত তিনি ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক লার্নার কলেজ অব মেডিসিনের মলিকুলার মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২০০৮ সাল থেকে তিনি ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া এট সান ফ্রান্সিস্কোর বায়োইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড থেরাপিউটিক সায়েন্সের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। ২০০৯ থেকে তিনি ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের নেফ্রোলজি বিভাগের এডজাংক্ট সহকারী স্টাফ হিসেবে কর্মরত।

ই-বার্তা /  তামান্না আলী প্রিয়া