দেশে ৯৯ দশমিক ৯৯ ভাগ মানুষের ঘরে পৌঁছে গেছে বিদ্যুৎ

ই-বার্তা ডেস্ক ।।  রংপুর জেলার গঙ্গাচড়া উপজেলার লক্ষীটরি ও মর্ণো, এই দুই চরে মোট তিনটি গ্রাম। বসবাস মাত্র ৮১ পরিবারের। স্বাভাবিকভাবেই দুর্গম এলাকার এত স্বল্প সংখ্যক মানুষের খোঁজ বের করা কঠিন হলেও সরকারের শতভাগ বিদ্যুতায়ন প্রকল্পের আওতায় এদের খুঁজে বের করে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়েছে। দেশের ৯৯ দশমিক ৯৯ ভাগ মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার পর এখন দুর্গম এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার জন্য কাজ করে যাচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগ।

বছর কয়েক আগেও বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য নানা রকম ঝামেলা পোহাতে হতো গ্রাহকদের। এখন সেই চিত্র পুরোটা উল্টে গেছে। বছরের শেষ নাগাদ শতভাগ মানুষের ঘরে বিদ্যুতের আলো পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্য পূরণ হলে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশই এ কাজে প্রথম সাফল্য দেখাবে। এ অঞ্চলের প্রভাবশালী দেশ ভারতও এ ঘোষণা দিতে পারেনি। বরং ভারতের অনেক এলাকার মানুষ এখনও বিদ্যুতের সেবা থেকে বঞ্চিত।

পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) বলছে, গ্রিডের বাইরে থাকা ৭১১টি গ্রামের ১ লাখ ৪৮ হাজার ৭৯ জন গ্রাহকের এলাকায় তারা এরইমধ্যে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছে। প্রথমে দেশের ২৪টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির দুর্গম এলাকাকে চিহ্নিত করে এরইমধ্যে ১৬টি এলাকায় সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সংযোগ পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। গত কয়েক বছর আগে যা কল্পনাই করাই সম্ভব ছিল না।

সূত্র বলছে, নতুন করে চিহ্নিত ৩৪৮ গ্রামের ৮০ হাজার ৩৭৮ বাসিন্দাকে বিদ্যুৎ সংযোগের আওতায় আনার কাজ করা হচ্ছে। আগামী ডিসেম্বর নাগাদ এই কাজ শেষ হলে সব মানুষের ঘরেই বিদ্যুৎ পৌঁছে যাবে বলে দাবি করছে সরকার। এখন যা ৯৯ দশমিক ৯৯ ভাগ। আর দশমিক এক ভাগ মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছানো বাকি রয়েছে। আরইবি ছাড়াও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্বে থাকা ওয়েস্টজোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো) এবং উত্তরাঞ্চলের নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো) কিছু দুর্গম এলাকার মানুষকে বিদ্যুৎ দেওয়ার কাজ করছে।

শতভাগ বিদ্যুতায়নের সবথেকে বড় কাজটি করেছে আরইবি। আরইবির এক কর্মকর্তা তার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, আমরা কোথাও কোন ছাড় দেওয়ার চেষ্টা করিনি। কোথাও একজন মানুষ বা একটি পরিবার বসবাস করেন। তাকেও বিদ্যুৎ সংযোগের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ায় পিঞ্জরি ও কুশলা গ্রামে মাত্র চারটি পরিবার বসবাস করেন। আপনারা গিয়ে দেখে আসতে পারেন সেখানেও চারটি পরিবারকে চারটি সোলার হোম সিস্টেম দিয়ে এসেছি। বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা সারাদেশের অফগ্রিড এলাকার মানুষকে বিদ্যুৎ দিতে গিয়ে যেখানে যেভাবে দেওয়া সম্ভব সেখানে সেভাবেই দিয়েছি। কোথাও সোলার, কোথাও আবার সাবমেরিন ক্যাবল দিয়ে আমরা গ্রিড নিয়ে গেছি। সরকারের লক্ষ্য ছিল একটাই, সব মানুষকে বিদ্যুতের আওতায় আনতে হবে। আমরা সেই কাজটিই করার চেষ্টা করেছি।

রাজশাহী শহর রক্ষা বাঁধে দাঁড়ালেই চোখে পড়ে বিস্তীর্ণ এক চর, চর খিদিরপুর। চরে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ও রয়েছে। ভারত সীমান্ত লাগোয়া হাতে গোনা কিছু মানুষ এখানে বসবাস করেন। তাদের প্রধান পেশা কৃষি এবং পশুপালন। আগে কেউ কেউ নদীতে মাছ ধরলেও এখন আর তেমন জাল নিয়ে বের হন না। শহরের এত কাছে হলেও এই খিদিরপুরে সাবমেরিন ক্যাবলে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে হলে ৪০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করতে হতো। নেসকো এ এলাকার মানুষকে বিনামূল্যে সোলার হোম সিস্টেম বসিয়ে দিয়েছে।

এই বিদ্যুতের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের দিন চর খিদিরপুরের রাহেলা বেগম বলেছিলেন কেরোসিনের বাতি আর বিজলি বাতির তফাতের কথা। আগে সন্ধ্যার পর কোনও কাজই করা যেত না। এখন সেখানে চাইলে যে কেউ সেলাইয়ের কাজও করতে পারেন। এখানে কেউ কেউ শহর থেকে কাপড় নিয়ে এসে কাঁথা তৈরির কাজ করেও জীবন নির্বাহ করেন বলে জানান তিনি। রাহেলা বলেন, আগে যেমন অনেক গরমে ঘুমানো যেত না, সারা রাত তালের পাখা টানতে হতো, এখন সেখানে ফ্যান চলে।

দুর্গম এসব এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ জ্বালানি খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, বছর কয়েক আগে আমার বাসায় একটি ছেলে কাজ করতো। সে তার গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার জন্য আমাকে অনুরোধ করে। সেই গ্রামে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার কিছু দিন পরে ছেলেটি একদিন আমাকে এসে জানায়, সে আর কাজ করতে চায় না। আমি তাকে বললাম কেন? কাজ করতে চাও না কেন? সে আমাকে জানালো, তার গ্রামে বিদ্যুৎ যাওয়ার পর সে একটি ধান ভাঙানোর মেশিন বসিয়েছে। অর্থাৎ বিদ্যুৎ যাওয়ায় সে স্বাবলম্বী হয়েছে। শুধু সে-ই নয়, তার সঙ্গে দেখা গেলো সেই ছোট্ট উদ্যোগেও দু’চার জনের কর্মসংস্থান হয়েছে। এই হচ্ছে পরিবর্তন। এক বা দুই বছরেই এই পরিবর্তন বোঝা যাবে না। এর একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব রয়েছে।

দুর্গম এলাকায় বিদ্যুতের এই সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার প্রশংসা করে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন বলেন, আমরা এখন এমন সব জায়গায় বিদ্যুৎ দিচ্ছি যেখানে দীর্ঘদিন মানুষ অন্ধকারে ছিলেন। বিদ্যুতের আলো পেয়ে তাদের ঘর যেমন আলোকিত হয়েছে, তেমনি কর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা হয়েছে। তবে এই যে একটি ভালো কাজ সরকার করছে, সেখানে কিছু তড়িঘড়িও হচ্ছে। আমাদের দুর্গম এলাকায় বিদ্যুতের আলো পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে মান ও অবকাঠামোর দিকে নজর দিতে হবে। না হলে এর সুবিধা সবাই ভালোভাবে নিতে পারবে না। উৎপাদন ও সরবরাহের পাশাপাশি তাই অবকাঠামোও যেন খুব ভালো হয়, সেটি আমাদের কঠোর নজরদারিতে রাখতে হবে।