পরকীয়া প্রেমিককে নিয়ে যেভাবে রথীশ চন্দ্রকে খুন করে স্ত্রী স্নিগ্ধা!

দুই মাস আগে পরিকল্পনা করা হয় হত্যার। এরপর ঘটনার দিন রাতে ভাত ও দুধের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে অচেতন করা হয়। পরে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয় অ্যাডভোকেট রথীশ চন্দ্র ভৌমিককে। স্ত্রীর পরকীয়ায় এভাবেই বলি হয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা, রংপুরের বিশেষ জজ আদালতের পিপি অ্যাডভোকেট রথীশ চন্দ্র ভৌমিক। রথীশের স্ত্রী স্নিগ্ধার মুখে হত্যার নির্মম বর্ণনা শুনে স্তব্ধ রংপুরবাসী। পরকীয়া প্রেমিক স্নিগ্ধার সহকর্মী কামরুল ইসলামসহ ৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

নিখোঁজের ৫ দিন পর মঙ্গলবার রাত ১২টায় সন্দেহের তালিকায় আসা রথীশের স্ত্রী স্নিগ্ধা ভৌমিককে র‌্যাব কার্যালয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে স্বামী অ্যাড. রথীশের হত্যার কথা স্বীকার করে। এরই ভিত্তিতে বাবুপাড়া বাসভবন থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে মোল্লাপাড়ার তাজহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক কথিত প্রেমিক কামরুল ইসলামের বড় ভাই খাদিমুল ইসলাম জাফরীর নির্মাণাধীন বাড়ি থেকে গর্তে থাকা লাশ উদ্ধার করে র‌্যাব। রংপুর র‌্যাব-১৩ অধিনায়ক মেজর আরমিন রাব্বীর নেতৃত্বে মধ্য রাত থেকে ভোর পর্যন্ত র‌্যাব ওই এলাকার চারপাশ ঘিরে ফেলে।

শুরু করা হয় লাশ উদ্ধারের প্রক্রিয়া। এরই মধ্যে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে অ্যাড. বাবু সোনার লাশ উদ্ধারের খবর। গভীর রাতে ওই স্থানে ছুটে যায় রংপুরে কর্মরত বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার সাংবাদিকসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। গলিত লাশ উদ্ধারে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। লাশ উদ্ধার করে শনাক্তের জন্য সেখানে আনা হয় নিহতের ভাই সাংবাদিক সুশান্ত ভৌমিক সুবলকে। তিনি তার ভাইয়ের পায়ের জুতা দেখে নিশ্চিত হন যে, নিহত ব্যক্তি তার ভাই অ্যাড. রথীশ চন্দ্র ভৌমিক বাবু সোনা। আলোচিত এ চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটনের খবর পেয়ে বেলা ১১টায় র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ হেলিকপ্টারযোগে রংপুরে ছুটে আসেন।

বেলা ১২টায় তিনি পাউবো সংলগ্ন র‌্যাব-১৩ কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বলেন, গত ৩০শে মার্চ বিশিষ্ট আইনজীবী রংপুর বিশেষ জজ আদালতের পিপি জাপানি নাগরিক হোশি কুনিও ও মাজার খাদেম রহমত আলী হত্যা মামলার সরকারি কৌঁসুলি, যুদ্ধাপরাধী এটিএম আজহারুল ইসলামের মামলার সাক্ষী রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক, রংপুর জেলা হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান কল্যাণ ট্রাস্টের ট্রাস্টি, রংপুর জেলা পূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি রথীশ চন্দ্র ভৌমিক বাবু সোনা নিখোঁজের পর থেকে র‌্যাব অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে এ রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা চালায়।

অ্যাড. রথীশ নিখোঁজের ঘটনায় ৩১শে মার্চ রংপুর কোতোয়ালি থানায় জিডি করা হয়। জিডির ভিত্তিতে র‌্যাব ছায়া তদন্ত শুরু করে। এর জন্য ঢাকা থেকে একটি বিশেষ দল ৫ দিন ধরে তদন্ত কার্যক্রম চালিয়েছে। পরবর্তীতে অ্যাড. রথীশের ছোট ভাই সুশান্ত ভৌমিক ১লা এপ্রিল রংপুর কোতোয়ালি থানায় একটি মামলা করেন। পরিবারের সকল সদস্যের দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদে তদন্তের ক্লু বের হয়ে আসে। এরই ধারাবাহিকতায় বিস্তারিত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে রথীশ চন্দ্র ভৌমিকের স্ত্রী স্নিগ্ধা ভৌমিককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য র‌্যাব কার্যালয়ে নিয়ে আসা হয়।

জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে স্নিগ্ধা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করে মৃতদেহের অবস্থান সম্পর্কে র‌্যাবকে জানায়। স্নিগ্ধা ভৌমিক জানায়, পরিবারিক কলহ, সন্দেহ ও অশান্তির কারণে সে পরকীয়া প্রেমে লিপ্ত হয়ে স্বামীকে হত্যার পরিকল্পনা করে এবং তাকে এ কাজে সহায়তা করে তার কথিত প্রেমিক কামরুল মাস্টার। হত্যার বিবরণ বিষয়ে র‌্যাব মহাপরিচালক জানান, প্রাথমিক তদন্ত ও তার স্ত্রীর দেয়া স্বীকারোক্তি মতে, দুই মাস আগেই তাকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। এরই অংশ হিসেবে ২৬শে মার্চ রাতে তাজহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক বাবু সোনার স্ত্রী স্নিগ্ধা ভৌমিকের সহকর্মী ও পরকীয়া প্রেমিক কামরুল ইসলামের নির্দেশে মাত্র তিনশ’ টাকার বিনিময়ে তাজহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র সবুজ ইসলাম ও রোকনুজ্জামান তাজহাট মোল্লাপাড়ায় নির্মাণাধীন ভবনের খোলা রুমের বালু খুঁড়ে রাখে। কামরুল মাস্টার তাদের শিক্ষক হওয়ায় তারা এ আদেশ পালন করে।

এরপর ২৯শে মার্চ রাত ১০টায় অ্যাড. বাবু সোনাকে ভাত ও দুধের সঙ্গে ১০টি ঘুমের বড়ি খাওয়ানো হয়। এরপর গলায় ওড়না পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে স্নিগ্ধা ও কামরুল মিলে রথীশকে হত্যা করে। হত্যার পর রাতে মৃতদেহ শয়ন কক্ষেই রেখে দেয়। কি ধরনের ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মেডিকেল পরীক্ষার মাধ্যমে পরে জানা যাবে। এখন আমরা প্রাথমিক তথ্যের ভিত্তিতে যা পেয়েছি তাই বলছি। ৩০শে মার্চ ভোর ৫টায় আলমারিতে লাশ ঢুকিয়ে কৌশলে আলমারি পরিবর্তনের নাটক সাজিয়ে কামরুল বাড়ি থেকে বের হয়ে চলে যায়। এরপর সকাল ৯টায় কামরুল ভ্যান নিয়ে আসে। লাশ গুম করার উদ্দেশ্যে নিহতের স্ত্রী তার প্রেমিকের সহায়তায় আলমারি পরিবর্তনের নামে ভ্যানে করে বাড়ির অদূরে তাজহাট মোল্লাপাড়ার সেই নির্মাণাধীন ভবনে নিয়ে যায়। যেখানে আগে থেকেই গর্ত করে রাখা হয়েছিলো। পরে সেই গর্তেই লাশ পুঁতে ফেলে তারা। এ ঘটনায় র‌্যাব হত্যাকারী স্নিগ্ধা ভৌমিক, তার প্রেমিক কামরুল ইসলাম, তাদের দু’ছাত্র সবুজ ইসলাম ও রোকনুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করেছে।

র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ বলেন, আমরা অ্যাড. রথীশের স্ত্রী, কথিত প্রেমিক এবং দুই ছাত্রকে পুলিশের হাতে সোপর্দ করেছি। এদিকে নিহত রথীশের লাশ উদ্ধারের পর রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে আইনজীবী সমিতির কোর্ট চত্বরে, পাবলিক লাইব্রেরি মাঠে টাউন হল চত্বরে নিয়ে আসা হয়। সেখানে প্রিয় মানুষ অ্যাড. রথীশকে এক নজর দেখার জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ সর্বস্তরের মানুষের ঢল নামে। ফুলেল শুভেচ্ছা দিয়ে শেষ শ্রদ্ধা জানানো হয় এ প্রিয় মানুষকে। সেখান থেকে সন্ধ্যায় লাশ দখিগঞ্জ শ্মশানে দাহ করা হয়। এ সময় হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্যপরিষদের নেতা বনমালী পাল তার প্রতিক্রিয়ায় মানবজমিনকে বলেন, ঘটনাটি এমন হয়ে যাবে আমরা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি।

উল্লেখ্য, রংপুর নগরীর বাবুপাড়ার বাড়ি থেকে গত শুক্রবার ভোরে নিখোঁজ হন আইনজীবী রথীশ চন্দ্র ভৌমিক। নিখোঁজ রথীশের সন্ধানে মাঠে নামে র‌্যাব, পুলিশ, পিবিআইসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা। মোবাইল ফোনের কল লিস্টের সূত্র ধরে আইনজীবীর স্ত্রী স্নিগ্ধা ভৌমিক এবং তার সহকর্মী স্কুলশিক্ষক কামরুল ইসলামকে সন্দেহের তালিকায় রাখে। এদিকে আইনজীবী রথীশের নিখোঁজের খবর ছড়িয়ে পড়লে উত্তপ্ত হয়ে উঠে রংপুর। রথীশের সন্ধানের দাবিতে আওয়ামী লীগ, আইনজীবী সমিতি, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্যপরিষদ, পূজা উদযাপন পরিষদ, ক্ষত্রিয় সমিতি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন আন্দোলনে নামে। সড়ক অবরোধ, বিক্ষোভ সমাবেশ, মানববন্ধন, স্মারকলিপি প্রদান, সংবাদ সম্মেলন, গণঅনশন থেকে শুরু করে সব ধরনের আন্দোলনে তোলপাড় শুরু হয় প্রশাসনে। উত্তেজনা দেখা দেয় সর্বস্তরে। বিক্ষোভ সমাবেশে রথীশ নিখোঁজ ঘটনার জন্য জঙ্গি, জামায়াত-শিবির ও বিএনপিকে দায়ী করা হয়। রংপুর রেঞ্জ ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক, জেলা প্রশাসক এনামুল হাবীব, পুলিশ সুপার মিজানুর রহমানসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা অ্যাড. রথীশের বাসায় ছুটে যান। দেন তাদের পরিবারকে সান্ত্বনা। সেই সঙ্গে তদন্ত উদ্ঘাটন ও নিখোঁজের রহস্য বের করতে মাঠে নামে প্রশাসন। সকল জল্পনাকল্পনা শেষে অ্যাড. রথীশের লাশ উদ্ধার করে এ নিখোঁজ সংবাদের অবসান ঘটান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

ওদিকে এলাকাবাসীর সূত্রে জানা যায়, তাজহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ছিলেন রথীশ চন্দ্র ভৌমিক। সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তার স্ত্রী স্নিগ্ধা ভৌমিক সহকারী শিক্ষিকা ছিলেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি করার সুবাদে শিক্ষক কামরুল ইসলাম, মতিয়ার রহমান, মিলন মহান্তদের সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠে। এর আগেও মতিয়ার রহমানের সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা শোনা যায়। পরবর্তীতে কঠিনভাবে পরকীয়ায় আসক্ত হয়ে পড়ে কামরুল ইসলামের সঙ্গে। এনিয়ে তাদের পরিবারে দেখা দেয় অশান্তি। এই অশান্তি থেকে পরিত্রাণ পেতে এবং কামরুলকে নিয়ে নতুন ঘর বাঁধার স্বপ্ন পূরণ করতে পরিকল্পিতভাবে এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটায়।সূত্র মানবজমিন।

ই-বার্তা/এস