বরফের প্রথম দিকের ইতিহাস

ই-বার্তা।। পানিকে ঠান্ডা করলে একসময় তা বরফে পরিণত হয়- এ কথা একটি পাঁচ বছরের বাচ্চাও জানে। আর শীতপ্রধান দেশের মানুষের বরফ নিয়েই তো বসবাস। অর্থাৎ বরফ অচেনা নয় কারো কাছেই। কিন্তু সারা বছর বরফ কাজে লাগতে পারে বা সারা বছর বরফ পাওয়া যেতে পারে, এমন ধারণা এককালে মানুষের মাথায় আসতোই না। তাহলে কার মাথায় এসেছিল এই সুবুদ্ধি?

সেই ১৮০৫ সালের কথা। বেশ কিছু দিন আগের কথা। বোস্টনের এক ধনী পরিবারের দুই ভাই, উইলিয়াম এবং ফ্রেডেরিক টিউডর, তাদের পারিবারিক বনভোজনে খুব আনন্দ করে দামি দামি ঠান্ডা পানীয় আর আইসক্রিম খাচ্ছিল। বলে নেয়া ভালো, শীতপ্রধান দেশগুলোতে আইসক্রিম পরিচিতি পেয়েছিল এর অনেক আগেই। তো খেতে খেতে উইলিয়াম টিউডরকে বলল, ওয়েস্ট-ইন্ডিজের জনগণ আমাদের এই ঠান্ডা পানীয় উপভোগ করা দেখলে হিংসায় মরে যাবে। কী বলিস? এই সামান্য কথাটি তখন টিউডরের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিল।

টিউডর তখন পরিকল্পনা করে ফেলেন যে তিনি জাহাজে করে বরফ নিয়ে তা ইংল্যান্ড থেকে ক্যারিবিয়ানে যাবেন। তিনি তার ভাই উইলিয়ামকেও রাজি করালেন তার পরিকল্পনায় অংশগ্রহণে। তার যুক্তি ছিল এই যে, মানুষ যদি একবার বরফের গুরুত্ব বুঝতে পারে তাহলে এটি ছাড়া চলতেই পারবে না।

এর পরবর্তী ছয় মাস দুই ভাই টাকা ঢালতে থাকেন পারস্যের দ্বীপে জাহাজে করে বরফ নিয়ে যাবার জন্য। কেন পারস্যের দ্বীপ? কারণ টিউডর আশা করেছিলেন যে সেখানে তিনি সহজেই একচেটিয়া বরফ ব্যবসা করতে পারবেন। প্রথমে কেউ বিশ্বাসই করেনি যে তাদের এই বুদ্ধিটি কাজে লাগতে পারে। শুধু তা-ই নয়, বরফ নিয়ে যেতে বোস্টন থেকে একটি জাহাজের মালিককেও রাজি করাতে পারছিলেন না তারা। নিরুপায় হয়ে টিউডর তাদের মূলধনের থেকে প্রায় পাঁচ হাজার ডলার দিয়ে একটি জাহাজ কিনে ফেলেন।

১৮০৬ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারি প্রায় ৮০ টন বরফ নিয়ে টিউডরের জাহাজ মারটিনিক নামন দ্বীপের উদ্দেশ্যে বোস্টন বন্দর ত্যাগ করে। যখন তাদের জাহাজ পৌঁছালো তখনও বরফগুলো কিন্তু অক্ষতই ছিল। তবুও সেখানকার কেউ তা কিনতে রাজি হলো না। টিউডর তাদেরকে বিভিন্নভাবে বোঝাতে থাকলেন বরফের প্রয়োজনীয়তা। কিন্তু একজনকেও তিনি রাজি করাতে পারলেন না! অবস্থা বেগতিক বুঝে তার ভাই উইলিয়াম অংশীদারিত্ব বাতিল করে চলে যান। পরের বছর শীতে এবার একাই জাহাজ নিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের অন্য স্থানে যান টিউডর। কিন্তু পরপর দুই বছর ব্যবসায় ভরাডুবি। ১৮১০ সালে সফলতার মুখ দেখেছিল তার বরফ ব্যবসা। তবে ১৮০৯ সাল থেকে ১৮১৩ সালের মধ্যে ঋণখেলাপির দায়ে তিনবার তাকে জেলেও যেতে হয়েছিল।

১৮১৯ সালে তিনি সাউথ ক্যারোলিনার এক বোর্ডিং হাউজে থাকতেন। সেখানে প্রতিদিন রাতের খাবারের সময় বরফ দেয়া ঠান্ডা পানীয় আনা শুরু করেন। এই দেখে বোর্ডিং এর অন্যান্য সদস্য ঠাট্টা-তামাশাও কম করেনি। এক কি দুই চুমুক দেবার পরেই তারা বরফের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে থাকেন।

টিউডর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ভ্রমণ করেছেন এবং সব জায়গার মদের দোকানদারদের একই দামে দুই ধরনের পানীয় রাখতে রাজি করান, কোনটি জনপ্রিয়তা পায় দেখার জন্য- একটি বরফ দেয়া এবং অপরটি বরফ ছাড়া। তিনি রেস্টুরেন্টগুলোতে গিয়ে আইসক্রিম বানানো শিখিয়েছেন। জ্বরাক্রান্ত রোগীদের ঠান্ডা রাখতে বরফের ব্যবহার বোঝাতে তিনি হাসপাতালেও ডাক্তারদের কাছেও গিয়েছেন। সকলেই অবাক হয়েছিল বরফের এত ব্যবহার থাকতে পারে ভেবে। একবার এটি বুঝতে পারার পর বরফ ছাড়া বেঁচে থাকাটাই অসম্ভব মনে হয়েছিল অনেকের কাছে! এর ফলে অনেক জায়গায়ই তিনি বরফের চাহিদা তৈরি করতে পেরেছিলেন। ১৮২১ সালে টিউডরের বরফ ব্যবসা শক্তিশালী হয়ে ওঠে।

১৮৪৭ সালে ৫২,০০০ টন বরফ নিয়ে টিউডর জাহাজে বা ট্রেনে করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ২৮টি দেশে গিয়েছেন। ম্যাসাচুসেটসে তিনি একটি বরফের পুকুর তৈরির অনুমতিও পেয়েছিলেন। টিউডর তার জীবনের লক্ষ্য পূরণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। অঢেল সম্পত্তির মালিক হতে পেরেছিলেন তিনি। সফলতার মুখ দেখেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ১৮৬৪ সালে।

ফ্রেডেরিক টিউডর ১৩ বছর বয়সের পর তিনি লেখাপড়া ছেড়ে দেন। তারপর আড্ডাবাজি, খেলাধুলায় কয়েক বছর কাটিয়ে নিজের এলাকা ছেড়ে বাইরে চলে যান। তারপর শিকার করা, মাছ ধরা আর ফার্মিং নিয়ে সময় কাটাতে থাকেন। তো একদিন তার ভাই উইলিয়াম অনেকটা তাচ্ছিল্যের সাথেই তাকে বলেন তাদের এলাকার পুকুরে বরফের চাষ করে তা ওয়েস্ট ইন্ডিজে পাঠানোর কথা। টিউডর কথাটি খুবই গুরুত্বের সাথে নেন।

১৮৬০ সাল থেকেই আমেরিকায় বরফ নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গিয়েছিল। এমনকি গৃহযুদ্ধ চলাকালীন সময়েও দক্ষিণ থেকে উত্তরে বরফের যোগান চলতো। তাজা মাংস, সবজি, দুধ পেতে বরফের ব্যবহার অনেক বেড়ে যায় এবং বিংশ শতাব্দীর শুরুতেই আমেরিকার প্রায় প্রতিটি মুদির দোকানের বরফের বাক্স খুঁজে পাওয়া গেল। কিন্তু বরফ ব্যবসায়ীদের কপাল পুড়লো প্রযুক্তির বিস্ময়কর অবদানে। আবিষ্কৃত হলো ইলেক্ট্রিক রেফ্রিজারেটর। ১৯৪০ সালের পর থেকে এই রেফ্রিজারেটর সকলের হাতের নাগালে চলে আসে এবং ঘরেই সবাই বরফ তৈরি করে নিতে পারে।