বাবা হত্যার বিচারে কাশ্মীরীকন্যার লড়াই!

ই-বার্তা ।।  ১৯৯৩ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি রাত। শ্রীনগরের ফতেহ কাদাল এলাকা ঘিরে ফেলেছিলেন ভারতীয় সেনারা। এর পর তারা তুলে নিয়ে যান অসুস্থ মুশতাক আহমেদ ভুট্টোকে। এর ৮৩ দিন পর তার মৃতদেহ পায় পরিবার। 

ওই ঘটনার সময় মুশতাক এক ও দুই বছরের দুটি মেয়েশিশু রেখে যান। এর মধ্যে ছোট মেয়েটির নাম জিনাত ভুট্টো। তিনি এখন পড়ছেন আইন বিভাগে।

ছোট্ট বয়সে বাবাকে হারানো কথা ভুলেননি বর্তমানে ২৬ বছরের তরুণী জিনাত। বাবাকে হত্যায় জড়িত সেনাদের বিচারের মুখোমুখি করতে তিনি কাশ্মীরের রাজ্য মানবাধিকার কমিশনে আবেদন করেছেন।

মা মেহমুদার কাছে বারবার বাবার কাহিনি শুনেছেন জিনাত। তিনি বলেন, মায়ের কাছ থেকে শুনেছি- ১৯৯৩ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি রাতে ফতেহ কাদাল ঘিরে ফেলেন ভারতীয় সেনারা। ওইদিন আমার বাবার প্রচণ্ড জ্বর ছিল। এর মাত্র কয়েক দিন আগে আমার দাদা মারা গিয়েছিলেন।

জিনাত বলেন, সেনারা যখন আমার বাবাকে ঘর থেকে বের হতে বলেন। তখন তার হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। এতে তার চোখেমুখে আশঙ্কার ছাপ তৈরি হয়, যা দেখে সন্দেহবশত সেনারা তাকে ধরে নিয়ে যান।

তিনি বলেন, এর পর আমার মা কয়েক দিন ধরে বাবাকে খুঁজতে থাকেন। একদিন বাদামিবাগ ক্যান্টনমেন্টের এক পরিচ্ছন্নতাকর্মী আমাদের বাড়িতে এসে মাকে একটি হাতঘড়ি দিয়ে বলেন, আপনার স্বামী বাদামিবাগ ক্যান্টনমেন্টে বন্দি আছেন। তিনি ঘড়িটি পাঠিয়েছেন যাতে এটি দেখে আপনি আমার কথা বিশ্বাস করেন।

এর পর জিনাতের মা মেহমুদা ভুট্টো ও অন্য আত্মীয়রা মুশতাককে দেখতে বাদামিবাগ ক্যান্টনমেন্টে যান। সেখানে মুশতাক তাদের জানান, সেনারা তাকে অত্যাচার করেছে।

এই সাক্ষাতের কিছু দিন পরেই মুশতাককে কোটবালওয়াল জেলে স্থানান্তর করা হয় উল্লেখ করে জিনাত বলেন, ১৯৯৩ সালের ২৭ এপ্রিল আমরা বাবার লাশ পাই।

তিনি বলেন, সাত বছর বয়স পর্যন্ত আমি বাবার মৃত্যুর বিষয়ে কিছুই জানতাম না। কিন্তু আমি ধারণা করতাম কিছু একটা হয়েছে। কারণ লোকজন বাবার বিষয়ে কিছু একটা বলত এবং তারা আমাকে দেখলেই চুপ করে যেত।

জিনাত বলেন, অনেক বছর ধরে আমাকে বলা হতো- তোমার আবু (বাবাকে আমি আবু ডাকতাম) দিল্লিতে কাজ করেন। যখন কোনো বিমান উড়ে যেত, তখন বাড়ির লোকজন বলতেন, ‘এই তো তোমার আবু এসে পড়ছে।

তবে জিনাতরা বড় হওয়ার পর তার মা আর প্রকৃত সত্য গোপন করে রাখেননি। জিনাত বলেন, পরে মা আমাদের বলেছেন- কীভাবে বিয়ের মাত্র চার বছরের মাথায় তিনি বিধবা হয়েছেন এবং ভারতীয় সেনারা কীভাবে আমাদের পরিবারকে ধ্বংস করেছেন। জিনাত বলেন, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি বাবার জন্য লড়ব। তবে আমি জানতাম না কীভাবে লড়ব, কিন্তু আমি কিছু একটা করতে চাইতাম।

তিনি বলেন, আমি যখন স্কুলে পড়তাম, তখন আমি পুলিশ অফিসার হয়ে বাবার হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার কথা ভেবেছিলাম। পরে ভাবলাম আইনজীবী হয়ে আমার বাবার জন্য লড়ব।

এরপর থেকেই লড়াই করার কথা ভেবেছেন জিনাত। প্রথমে পুলিশ অফিসার হওয়ার কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু কাশ্মীরে বেশি নারী পুলিশ কর্মকর্তা নেই। সে কারণে আইনজীবী হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ধার্মিক মুসলিম তরুণী জিনাত হিজাব পরেন। কাশ্মীরে হিজাব পরেও আইনি লড়াই করা যায়।

২০০৯ সালে জিনাতের বড় বোন তার বাবার মৃত্যুর বিষয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রতিবেদন চেয়ে কাশ্মীরের রাজ্য মানবাধিকার কমিশনে (এসএইচআরসি) আবেদন করেন।

তবে গত ১০ বছর ধরে এসএইচআরসি মুশতাকের মৃত্যুর বিষয়ে রিপোর্ট চেয়ে এলেও ভারতীয় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে কোনো সাড়া দেয়া হয়নি।

অবশ্য বাবার খুনিদের বিচারের মুখোমুখি করতে দৃঢ় প্রতীজ্ঞ জিনাত বলছেন, কখনই তিনি বিচারের চেষ্টা ছাড়বেন না।

তিনি বলেন, বাবাকে হত্যার পর আমার মাকে অত্যন্ত কষ্ট করে বেঁচে থাকতে হয়েছে। তিনি কাপড় সেলাইয়ের কাজ করতে শুরু করেলও তেমন একটা উপার্জন হতো না। নানা-নানি আমাদের দুই বোনকে পড়াশোনা করিয়েছেন এবং বড় বোনকে বিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু নানা-নানিও মারা গেছেন। এখন বেঁচে থাকতেই আমাদের সংগ্রাম করতে হচ্ছে। তার পরও আমরা বাবার জন্য লড়ে যাব।