বিশ্বে ওষুধ ঘাটতি বাড়াবে করোনাভাইরাস

বিশ্বব্যাপী দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস। এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বিশ্ব অর্থনীতিতে। টানা দরপতনে শেয়ারবাজার, তেলের দামও নিম্নমুখী। তবে ভাইরাসটি এর চেয়েও বড় হুমকি হয়ে উঠেছে ওষুধ খাতের জন্য।

করোনাভাইরাস আতঙ্কের কারণে মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়েছে জ্বর-ঠান্ডাজনিত রোগের ওষুধ কিনতে। কিছু কিছু জায়গায় ঘাটতি দেখা দিয়েছে মাস্ক-হ্যান্ড স্যানিটাইজারের। তবে এগুলো সাময়িক সংকট।

বিশ্বে এর চেয়েও বড় সংকট হয়ে যেটি আসতে পারে তা হচ্ছে, ওষুধ সরবরাহে ঘাটতি। সম্প্রতি মার্কিন সাময়িকী উইয়ার্ড প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসের উৎস চীনে, আবার এর সংক্রমণ থেকে বাঁচতে প্রয়োজনীয় পণ্যগুলোর বড় উৎপাদকও তারা- বিষয়টি অদ্ভূত। মানুষ জীবনরক্ষাকারী পণ্যের জন্য চীনা কোম্পানিগুলোর ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। বিশ্বে ওষুধের উপাদান উৎপাদনকারী অন্যতম দেশও চীন।

যদিও করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে এখনই ওষুধ সংকটের কথা বলা যাচ্ছে না, তবে সেটি সরবরাহের ক্ষেত্রে যথেষ্ট হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

জরুরি ওষুধ সরবরাহের ক্ষেত্রে চীনের ওপর অতিনির্ভরশীলতা দেশের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে বলে সতর্ক করেছেন জন হপকিন্স সেন্টার ফর হেলথ সিকিউরিটির সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ আমেশ অ্যাডালজা। তিনি বলেন, সরবরাহের ওপর যে কোনও ধরনের আঘাত বা অস্থিরতা ওষুধ সরবরাহকে দুর্বল করে দেয়। এ সংক্রমণে আমাদের সরবরাহ শৃঙ্খলার স্থিতিশীলতা অক্ষুণ্ন থাকবে কি না তা চিন্তার বিষয়।

করোনাভাইরাসের উৎস উহান শহর চীনের সবচেয়ে বড় ওষুধ প্রস্তুতকারী শহর না হলেও এটি ইস্পাত ও ভারী শিল্পের জন্য পরিচিত। শহরটি ধীরে ধীরে বায়ো-ফার্মাসিউটিক্যাল গবেষণা ও উন্নয়নেরও কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছে। তবে ভাইরাস সংক্রমণের পর এক কোটি ১০ লাখ মানুষের শহরটি কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে।

সেখানে ভ্রমণ নিষিদ্ধ, যান চলাচল বন্ধ, বিমান বন্ধ, ট্রেন চলাচলও বন্ধ হয়ে গেছে। হুবেই প্রদেশের অন্তত ১৬টি শহরে একই ধরনের নিষেধাজ্ঞা চলছে। সংক্রমণ এড়াতে চীনা নববর্ষের ছুটি বাড়ানো হয়েছে, আগামী ৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ব্যবসা-বাণিজ্য স্থগিত করেছে দেশটি।

যুক্তরাষ্ট্রের খাবার ও ওষুধ প্রশাসনকে (এফডিএ) যেকোনো ধরনের সরবরাহ ঘাটতি অবগত করতে হয় দেশটির ওষুধ প্রস্তুতকারকদের। তবে এখন পর্যন্ত কেউ সংকটের কথা জানায়নি বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।

উতাহ হেলথ ইউনিভার্সিটির ফার্মাসিস্ট ও ওষুধ বিশেষজ্ঞ এরিন ফক্স জানান, চীন জাহাজে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ওষুধের কাঁচামাল সরবরাহ করে, তারা বেশ কিছু উপাদানের আবিষ্কারকও। এ কারণে সরবরাহের ঘাটতির জন্য প্রায় এক মাস লেগে যেতে যারে।

‘তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, অতিগুরুত্বপূর্ণ ওষুধগুলোর কতটুকু চীনে উৎপাদিত হয়, আর সেই ফ্যাক্টরিগুলোও কোন কোন জায়গায়, সে সম্পর্কে সুনিশ্চিত তথ্য কারও কাছে নেই। ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো এসব তথ্য গোপনই রাখতে চায়।’

তিনি বলেন, আরেকটি বড় অজানা বিষয় হচ্ছে, এর কতগুলো পণ্যের একটাই উৎস, অর্থাৎ বিশ্বের মাত্র একটি জায়গাতেই ওই মালামাল তৈরি হয়। আমাদের কাছে এ সম্পর্কে মোটেও ভালো তথ্য নেই।

এফডিএ’র তথ্যমতে, বিশ্বের ৩৭০টি প্রয়োজনীয় ওষুধের কাঁচামাল তৈরির ১৫ শতাংশ স্থাপনা চীনে অবস্থিত, যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে ২১ শতাংশ। কিন্তু ওইসব স্থাপনায় কতটুকু ওষুধ উৎপাদন করা হয় সে সম্পর্কে পরিষ্কার তথ্য নেই সংস্থাটির কাছে।

আমেরিকান সোসাইটি অব হেলথ সিস্টেম ফার্মাসিস্টের মাইকেল গানিও বলেন, তথ্যের এই অপর্যাপ্ততাই বিচলিত করছে। যেকোনও ধরনের ভূ-রাজনৈতিক ইস্যু বা এটার (করোনাভাইরাস) মতো প্রাদুর্ভাব অথবা কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগ জাতীয় স্বাস্থ্যসেবার জন্য কতটা হুমকি- আমরা সত্যিই জানি না।

গত ৩১ ডিসেম্বর চীনের হুবেই প্রদেশের উহানে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত প্রথম রোগীর সন্ধান পাওয়া যায়। এরপর থেকে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা। দেশটিতে এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ১৩২ জন, আক্রান্ত প্রায় ছয় হাজার।

চীন ছাড়াও ১৮টি দেশের অন্তত ৭৮ জন এ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। চীনা গণমাধ্যম সিনহুয়ায় এক বিশেষজ্ঞের বরাতে বলা হয়েছে, আগামী ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা সর্বোচ্চ আকার ধারণ করতে পারে।

এখন পর্যন্ত থাইল্যান্ড, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, নেপাল, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জার্মানি, কম্বোডিয়া, শ্রীলঙ্কা এবং তাইওয়ানে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নতুন এ ভাইরাসের নাম দিয়েছে ২০১৯ নভেল করোনাভাইরাস। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে চীনে সফর করেছেন এমন লোকজনের মাধ্যমেই এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে। সে কারণে অনেক দেশই এ ভাইরাসের প্রকোপ ঠেকাতে চীন সফরে নাগরিকদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।

এদিকে, প্রথমবারের মতো অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে গবেষণাগারে করোনাভাইরাস তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন বিজ্ঞানীরা। একে করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কারের পথে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হিসেবে দেখছেন তারা।

করোনা ভাইরাস আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ কী?
এ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে শুরুতে জ্বর ও শুষ্ক কাশি হতে পারে। এর সপ্তাহখানেক পর শ্বাসকষ্টও দেখা দেয়। অনেক সময় নিউমোনিয়াও হতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে রোগীর অবস্থা বেশি খারাপ হওয়ায় তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা লাগে। তবে এসব লক্ষণ মূলত রোগীরা হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরই জানা গেছে।

সেক্ষেত্রে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার একদম প্রাথমিক লক্ষণ কী বা আদৌ তা বোঝা যায় কি-না তা এখনও অজানা। তবে নতুন এই করোনাভাইরাস যথেষ্ট বিপজ্জনক। সাধারণ ঠান্ডা-জ্বরের লক্ষণ থেকে এটি মৃত্যুর দুয়ার পর্যন্তও নিয়ে যেতে পারে।