মানুষের হাট !

তারিকুল হাসান ।। শীতের হালকা কুয়াশায় ঢাকা শহর, গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। হিম শীতল আবহাওয়ায় বাঁশের ডালি আর কোদাল হাতে মানুষগুলো ভীর জমাচ্ছেন মানুষের হাটে! হ্যা ঠিকই শুনেছেন, মানুষের হাটে, মানুষ কেনা বেচার হাটে!

প্রাচীনকালে ও মধ্যযুগে সমাজে মানুষ কেনা বেচার হাট বসত। সেই দাস প্রথা বিলুপ্ত হয়েছে কবেই।  কিন্তু একাবিংশ শতাব্দীর তথ্য-প্রযুক্তির যুগেও ক্ষুধা আর দারিদ্রতার নির্মম আঘাতে নিম্ন আয়ের মানুষগুলা দু বেলা রুটিরুজির জন্য আজও নিজেকে বেঁচে দেন মানুষের হাটে।

রাজধানীর রায়ের বাজার মুক্তি সিনেমা হল চত্বরে প্রতিদিন সকালে বসে মানুষ ক্রয় বিক্রয়ের হাট। রাজমিস্ত্রি, কাঠমিস্ত্রি, রংমিস্ত্রি, সেনেটারি মিস্ত্রি, দিনমজুরসহ নানা পেশার শ্রমজীবী মানুষে সরগরম হয়ে ওঠে এই বাজার। শ্রমের এই বাজারে শ্রমিক কিনতে আসেন মালিকেরা। অনেক শ্রমজীবী বিক্রি হলেও অনেক থেকে যান অবিক্রিত।

কুড়িগ্রামের ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙ্গনে ভেঙ্গে যাওয়া ঘর, রায়ের বাজার বেড়িবাঁধের সাদেক খান পেট্রোল পাম্পের পাশে ভাড়া বাড়িতে এসে আবার গড়েছেন এনামুল হক (৬০)। সংসার চালানোর জন্য নিজেকে প্রতিদিন বিক্রি করতে আসেন মানুষের হাটে, কোন কোন দিন থেকে যান অবিক্রিত।

দিনমজুর এনামুল হকের সাথে কথা হয়। তিনি বলেন, আট বছর আগে ব্রহ্মপুত্র নদে বাড়ি ভেঙ্গে যাওয়াও ঢাকায় চলে আসি। যখন যে কাজ পাই সেই কাজ করি। সন্তানেরা নিজেরাই চলতে পারেনা,আমাদের কি দেখবে? তাই প্রতিদিন কামলা দিতে হয়। কামলার হাটে দাম একটু বেশী পাই। কেউ কিনলে, কোনদিন ৫০০ আবার কোনদিন ৬০০ টাকা থাকে। বেচা না হলে সেদিন রিক্সা চালাই।

ধানমণ্ডির মধুবাজারের বন্ধন ভিলার মালিক মাহবুবুল আলম মানুষের হাটে এসেছেন রংমিস্ত্রি কিনতে। তিনি বলেন, বাড়ির সমানের দেওয়ালে রঙ করতে হবে, তাই এই বাজারে রংমিস্ত্রি কিনতে এসেছি। শ্রমিকের দাম একটু বেশী হলেও এখানে সহজে কাজের লোক পাওয়া যায়। একজন রংমিস্ত্রি নিয়েছি ৭০০ টাকায় আর দুইজন সহকারী মিস্ত্রি নিয়েছি ১০০০ টাকায়।

মানুষের এই হাটে বেচাকেনা চলে ভোর থেকে সকাল ৮ টা প্রযন্ত। দাম দর ঠিক হয়ে গেলে শ্রমজীবী মানুষগুলো রওনা হন মালিকের গন্তব্যে। সকাল ৯ টা থেকে বিকেল ৫ টা প্রযন্ত ঘাম ঝড়িয়ে কাজ করেন কঠোর পরিশ্রমী মানুষগুলো। মজুরী বুঝে পেলে এবার বাড়ি ফেরার পালা। এরপর আরও একটি ভোরের অপেক্ষা, কাজের জন্য ছুটেচলা মানুষের হাটে!

রায়ের বাজারের কাঠমিস্ত্রি শাহাদত হোসেনের জীবনও যেন জড়িয়ে আছে মানুষের হাটের সাথে। গত তিন বছর ধরে এই বাজারে বিক্রি হতে আসেন তিনি। মিস্ত্রির কাজের মজুরী কেমন জানতে চাইলে শাহাদত বলেন, ‘বাজারে মিস্ত্রির দাম ৭০০ টাকা আর শ্রমিক ও যোগালের  দাম একটু কম ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা।’

এক যুগেরও বেশী আগে থেকে মুক্তি সিনেমা হলের সামনের এই মানুষের হাট বসে। এছারাও মোহাম্মাদপুর টাউনহল ও বাসস্ট্যান্ড, হাজারিবাগ এবং রায়ের বাজার খেলার মাঠের পাশে মানুষের হাট বসে বলে জানান, রায়ের বাজার ছাতা মসজিদ এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা বশির আলী।

নিয়মিত হাট বসলেও মানুষের হাটে নেই কোন খাজনা, সমিতির ঝামেলা, হাট কমিটির চাঁদাবাজি। নিজের আপন গতিতেই চলে এই হাট। শ্রমজীবী মানুষেরা সেদিক দিয়ে শান্তিতে থাকলেও তাদের কাজের নিশ্চয়তা এবং জীবনের নিরাপত্তা অনিশ্চিত।