মা-মেয়েরা সাবধান!

সিমি (ছদ্ম নাম)। বয়স এগারো। ক্লাস ফোরে পড়ে। লম্বাটে গড়ন। ফর্সা। মায়াময় লাবণ্য চোখে মুখে ঢলঢল করে। তবে একটু যেনো দিশেহারা। অবশ্য এই বয়সী বাচ্চাকাচ্চা এমনই হয়। এরা সারাক্ষণ প্রজাপতির মতো উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়ায়।

 

অপার ঔৎসুক্যে সবকিছু দেখে। চোখ বড় বড় করে। জীবনকে জানতে চায়, চেখে দেখতে চায়। সিমিকে দেখলে মনে হয়, বয়ঃসন্ধি নামক অমোঘ প্লাবন আসি আসি করছে। হাত পা বাড়ন্ত। লক লকে লাউ ডগার মতো। দেখতে ভালো লাগে।

হঠাৎ সিমির পেটে ব্যাথা। উথাল পাথাল। সিমির মা বুঝে পান না, ব্যথার কারণ কী? ব্যাথার উৎস খুঁজতে গিয়ে পেটে হাত রাখে, দেখে সিমির পেটে একটা চাকার মতো। বেশ বড়সর। মায়ের হাত পা সমানে কাঁপছে।! টিউমার? দুশ্চিন্তার রেখা মায়ের কপাল জুড়ে। কিন্ত সিমির অতটা বোধ বুদ্ধি আছে বলে মনে হয় না।

সে শুধু কিছুক্ষণ পরপর ‘ব্যাথা, ওহ্ ব্যাথা’ বলে চিৎকার করছে। আর পেট মুচড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আসলে সিমি হাতপায়ে বাড়ন্ত হলেও, আচার আচরণে ছোট্টটিই আছে। শিশুই তো। ঋতুস্রাব এখনো হয়নি। সিমির শরীরটা অনেকদিন থেকেই ভালো যাচ্ছিল না। খেয়াল করলে বোঝা যায়, ও একটু মুটিয়ে যাচ্ছে যেনো। বাড়ন্ত বয়সের পরিবর্তন মনে করে মা তেমন মনোযোগ দেয়নি।

এদিকে সিমির ব্যাথা কিছুতেই কমছে না। ডাক্তার ম্যাডাম পেটে হাত দিয়েই কপাল কুঁচকে ফেললেন। কী যেনো একটু ভাবলেন। মুহূর্ত মাত্র। তারপরই বললেন, আলট্রাসাউন্ড করান। আর্জেন্ট! আল্ট্রাসনোগ্রাম করানো হলো। রিপোর্ট দেখে তো চক্ষু চড়কগাছ! সিমির পেটে টিউমার না। বাচ্চা! বত্রিশ সপ্তাহ! শিশুর পেটে আরেকটি শিশু!

খোদা, কলিকালে আর কী কী দেখব! সিমির মায়ের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। পায়ের নিচের মাটি সরসর করে সরে যায়। সব অন্ধকার হয়ে যায়। যেনো রঙিন একটা সুন্দর ছবিকে কালো কালিতে ডুবিয়ে দেয়া হলো।

নিকষ কালো আঁধারে ডুবে গেলো, সমাজ সংসার ভবিষ্যৎ। সব। আমার এত্ত বড় সর্বনাশ! কে করল? কান্নার মতো হাহাহাকার ঝরে পড়ে সিমির মায়ের কণ্ঠে। তিনি ভেবে পান না, ঋতুস্রাবই ছাড়া বাচ্চা? কেমনে কী? তার মাথা আউলা ঝাউলা হয়ে যায়। নিঃশ্বাস বন্ধ। এক ফোঁটা বাতাসের জন্য বুক আঁকুপাকু করে ওঠে। মনে হচ্ছে বুকের ছাতি ফেটে যাবে। মনে মনে বলেন, মাবুদ, এত বড় শাস্তি তুমি আমার মেয়েটাকে না দিলেও পারতা। আমার পাপ…কান্নার ধমকে কথা শেষ করতে পারেন না। দুই. দশ-এগারো বছরের একটা বাচ্চা।

 

প্রেগন্যান্ট! সেটা যেভাবেই হোক। এটা মেডিকো- লিগ্যাল কেস। পুলিশকে ইনফর্ম করতে হয়। ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টারে ভর্তি করা হলো। একটা দেশ সেরা মেডিকেল কলেজের ওসিসি সেন্টার এটেন্ডিং ডক্টর হিসাবে সিমির হিস্ট্রি নিচ্ছি ডা. নামিহা( ছদ্ম নাম)। পাঠক আসুন, আমরাও শুনি তাদের কথোপকথন : সিমি ভয় নেই। বসো। যা বলি মনোযোগ দিয়ে শোনো। খুব সহমর্মিতা নিয়ে কথাগুলো বলেন ডাক্তার ম্যাডাম। কিন্তু সিমি যেনো কিছু শুনছে না।

তাকে কিছুটা বিভ্রান্ত ও মনে হয়। দাঁড়িয়েই থাকে। একটু ইতস্তত বোধ করে। কাঁধে হাত রাখেন ম্যাম। অভয় দেন। সিমি মনে হয় একটু ভরসা পেল। আলতো করে বসল। ওর মা বসল পাশে। একটু দূরত্ব রেখে। : সিমি তোমার বয়স কত? : দশ। তবে এখানে এগারো দিয়েছি। মা দিতে বলেছে। শিশুসুলভ আচরণ প্রকট। আহারে মেয়ে! বড়দের লালসার ফাঁদে শিশু বয়সটা বিক্রি করে দিলে? : তোমার মাসিক হয়? সিমি মাসিক কাকে বলে জানে না।

ওর মা উত্তর দেয়, ‘না। কখনো হয় নাই। বয়স তো বেশি না ম্যাডাম। এই সেদিন হলো মেয়েটা আমার।’ বলেই চোখ মুছেন সিমির মা। : তোমাদের বাসায় কে কে থাকে? : আমি, মা আর ভাইয়া। বাবা থাকেন বিদেশ। মাঝে মাঝে নাবিদ আংকেল আসেন।

নাবিদের নাম উচ্চারনে মা একটু বিচলিত বোধ করেন। মনে মনে চান নাবিদের নামটা না আসুক। : নাবিদ আংকেল কে? কখন আসেন? : নাবিদ আংকেল আমাদের বাসার ঠিক উপরের তলায় থাকেন। মা বাসায় থাকলে আসেন। পড়াশোনা দেখিয়ে দেন। গল্পগুজব করেন, সবার সাথে। সিমির মা যেনো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। ‘নাবিদ আমার সন্তানদের নিজের সন্তানের মতো দেখে ম্যাডাম।’ বলেন সিমির মা। : আর? সিমি উত্তর দেয় না।

চুপ করে থাকে। কিন্তু মনে মনে ঠিকই বলে, ‘মা যখন অফিসে থাকেন। ভাইয়া স্কুলে। তখন কেউ একজন আসেন। দুপুর বেলা। নিয়মিত। মা শুনলে নিশ্চয় চিৎকার করে ওঠবেন। হয়তো শকেও চলে যাবেন। বেচারাকে আর শক দিতে ইচ্ছা করছে না। : তুমি স্কুলে যাও না? : যাই তো। আমার স্কুল বারোটায় শেষ হয়। তারপর আমি বাসায় থাকি। : তারপর? : সিমি একদম চুপ।

লেখক: ডা. ছাবিকুন নাহার,

মেডিকেল অফিসার,

ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল

কন্টেন্ট ক্রেডিট: মেডিভয়েস

 

ই-বার্তা/