মেজর মুক্তিযোদ্ধা স্বামী ও ৬ শহীদ সন্তানের জননী এখন ভিক্ষুক

ই-বার্তা ।।  দেশ স্বাধীনের পূর্বে ছিলেন মিরপুর বাংলা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। মেজর মুক্তিযোদ্ধা স্বামী ও ৬ শহীদ সন্তানের জননী মেহেরজান বিবি।  কিন্তু সহায় সম্বলহীন মেহেরজারেন ঠাঁই এখন ফেনী সদর উপজেলার ধর্মপুর আবাসন ও আশ্রয়ন প্রকল্পের ৩ নং ব্যারাকের ১১ নং কক্ষে।

বেঁচে থাকার আকুতি নিয়ে দুই বোগলে স্টেচারে ভর দিয়ে ভিক্ষা করেন এ বাড়ি ওবাড়ি। জীবনের এ প্রান্তে এসে আক্ষেপে প্রধানমন্ত্রীর কাছে মেহেরজান বিবির প্রশ্ন, বঙ্গবন্ধু আমার খোঁজ নিয়েছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমি উপেক্ষিত। এটাই কি আমার ভাগ্যে লেখা ছিল?

স্বাধীনতার পর তাঁর দুঃখ-কষ্টের কথা পত্রিকায় ছাপা হলে বঙ্গবন্ধু তাঁকে ও তাঁর এক পুত্রবধূ করফুলের নেছাকে ডেকে নিয়ে দুই হাজার টাকা করে অনুদান দেন এবং মেহেরজান বিবিকে হজ্ব পালন করান। কিন্তু এখন আর কেউ খবর রাখে না।

মেহেরজান বিবি’র ভাষ্য মতে, তাঁর ৮ পুত্র ও ২ মেয়ে ছিল। দুই মেয়ে মরিয়ম বিবি ও হাসনা বিবিও মারা গেছেন। তাঁর ছয় পুত্র এবং স্বামী এ টি এম সামসুদ্দিন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে শহীদ হন। তাঁর শহীদ ছেলেরা হলেন- ছায়েদুল হক (তৎসময়ে সিলেটে রিলিফ অফিসার পদে কর্মরত), দেলোয়ার হোসেন, বেলায়েত হোসেন, খোয়াজ নবী, নুরের জামান ও আবুল কালাম। বাকী দু’পুত্র শাহ আলম ও শাহ জাহানের সন্ধান জানেন না তিনি।

মেহেরজান বিবি কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানালেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বে তিনি ঢাকার মিরপুরে বাংলা মিডিয়াম হাই স্কুল (বর্তমানে মিরপুর বাংলা উচ্চ বিদ্যালয়) এর শিক্ষিকা ছিলেন। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনী তাঁর স্বামী ও ৬ সন্তানকে হত্যা করে খ্যান্ত হয়নি।  মুক্তিযোদ্ধা পরিবার জানতে পেরে মিরপুরে তাঁদের বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দেয়।

বয়সের ভারে ন্যুজ্ব ৮৮ বছর বয়স্কা অসহায় মেহেরজান বিবি প্রতিদিন মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ভিক্ষা করেন। তাঁর দুঃখে ভারাক্রান্ত জীবন কাহিনী বলতে বলতে অঝোরে চোখ বেয়ে নেমে আসে বেদনার অশ্রু। নিজে কাঁদেন এবং কাঁদান অন্যকেও।  এই বয়সে দুই বগলে স্টেচারে ভর দিয়ে গ্রামে দু’মুঠো ভিক্ষার জন্য ঘুরে বেড়ান মেহেরজান। চরম অসহায়ত্বের মাঝে দিন কাটছে তাঁর।

স্বাধীনতা যুদ্ধের পর স্বামী সন্তানদের শহীদ হওয়ার খবরে তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। দীর্ঘদিনেও তাঁর পুরাপুরি মানসিক সুস্থতা ফিরে আসেনি।  স্বজনদের হারিয়ে চরম অসহায়ত্বে পড়ে ভিক্ষাভিত্তির পথ বেছে নেন তিনি।

২০০৯ সালে ফেনী রেল স্টেশনে ভিক্ষা করতে দেখে জনৈক জিআরপি পুলিশ তাঁকে ফেনী জেলা প্রশাসনে পাঠায়।  তখন জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে তাঁকে পুর্ণবাসনের ব্যবস্থা করা হয় ধর্মপুর আবাসন প্রকল্পে।  সেই থেকে তিনি এখানে বসবাস করছেন।

পৈতৃক নিবাস চাঁদপুর সদর উপজেলার বাবুর হাটস্থ ২৬ নং দক্ষিণ তরপুর চন্ডী গ্রামে ১০ অক্টোবর  ১৯৩০ সালে জন্মগ্রহণ করেন মেহেরজান বিবি। বাবা ইব্রাহীম উকিল, মা বিবি হনুফা।  তারা ছিলেন  ৬ ভাই বোন। সোনাগাজী উপজেলার ৬নং চরছান্দিয়া ইউনিয়নের বড়ধলী হাজী বাড়ির মরহুম মমতাজ উদ্দিনের ছেলে সুবেদার মেজর এ টি এম সামসুদ্দিনের সাথে মেহেরজান বিবির বিয়ে হয়। পঞ্চাশের দশকে বড়ধলী গ্রাম নদী গর্ভে বিলিন হলে নিঃস্ব হয়ে তারা শহরে চলে আসেন। বাসা ভাড়া করেন ঢাকার মিরপুর ১ নাম্বারে জালাল দারগার বাড়িতে।

সোনাগাজী উপজেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সৈয়দ নাসির উদ্দিন জানান, মেহেরজান বিবি সম্পর্কে পত্র-পত্রিকায় অনেক লেখালেখি হয়েছে, তবে কোন কাজ হয়নি। তাঁর স্বামী-সন্তান যে শহীদ হয়েছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই।  আমি গেজেটে তাঁর নামও দেখেছি।

মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, ফেনী জেলা ইউনিটের ডেপুটি কমান্ডার আবদুর রহমান মজুমদার বলেন, দীর্ঘদিন থেকে মেহেরজান বিবির সাথে আমার সম্পর্ক।  তিনি আমাকে খুব স্নেহ করেন এবং ছেলে ডাকেন।

ফেনীর জেলা প্রসাশক মনোজ কুমার রায় বলেন, আশ্রায়ন প্রকল্পে সুবিধা ভোগীর একজন মেহেরজান। আমরা তার সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পেরেছি। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ছয় সন্তান ও স্বামী হারিয়েছেন। এই ছাড়া তাঁর অনেক করুন কাহিনী শুনেছি। তাঁর জন্য সার্বিক সহযোগিতা করা হবে।

 

ই-বার্তা/এস