যে কারণে নড়ে উঠছিল মৃত নবজাতক লাশ

ই-বার্তা ডেস্ক ।।  তিন বছরের টুনটুন ছিল বাবা-মায়ের চোখের মনি। সারা দিন বাড়ির এ মাথা থেকে ও মাথা ঘুরে বেড়াত টু টু করে। ব্যস্ত রাখত সবাইকে। কিন্তু আজ দুপুরে টুনটুনদের বাড়িতে কান্না আর আহাজারি। টুনটুনের মা বিলাপ করছেন আর মূর্ছা যাচ্ছেন বারবার। একি হলো, কেনো হলো। বিধাতা তাকে কেন এমন কঠিন পরীক্ষায় ফেললেন।

বাবার অফিসে যাওয়ার সময় বেশ খানিকটা দূর পর্যন্ত টুনটুন তার পিছু পিছু আসত। তারপর বাবা তাকে শেষবার কোলে নিয়ে একটা চুম দিয়ে ঘরের দিকে ফিরিয়ে দেন। এটা প্রায় প্রতিদিনের রুটিন, আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি।

 

বাবার অফিসে যাওয়ার পর মায়ের খেয়াল হঠাৎ হয় টুনটুন আশপাশে নেই। অফিসে যাওয়ার পর সে’তো পাশেই খেলে। আজ একটু খালি খালি। টুনটুনটা কই। এ ঘর ও ঘর খোঁজাখুঁজি করে আঁতকে উঠে তার মন। টুনটনের বাবাকে ফোন দেন তিনি।

 

“সে আমার পিছু পিছু আসছিল, আমি তো তাকে ঘরে ফিরিয়ে দিই, দ্যাখো ভালো করে ঘরে, উঠোনে কিনা…” তিনি বলেন।

 

টুনটুনের মা আর কোনো কথা নেই, এক দৌড়ে যান পুকুর ঘাঠে। টুনটনের পানির প্রতি খুব আকর্ষণ। হাঁটা শেখার পর থেকে সে সুযোগ পেলেই পুকুরপাড় যেতে চায়। একদিন দুপুরে সেখান থেকে উদ্ধার করেন মসজিদের ইমাম। সেদিন তিনি কড়া করে সতর্ক করেছিলেন, “এমন যেন না হয়”, আরও বলেছিলেন, “বাঁশের বেড় দিয়ে পুকুরঘাট টি আলগ করে দিও তোমরা”। আজ দিচ্ছি, কাল দিচ্ছি করে দেয়া হয়নি। চৌধুরী বাড়ি থেকে বের হয়েই রাস্তার বাঁ-পাশে বিশাল এক পুকুর।

 

পুকুরঘাটে এসেই টুনটুনের মা চিৎকার দেয়ে অজ্ঞান। মাঝপুকুরে টুনটুনের লাল জামাটা ভাসছে। চাচা মামারা ঝাঁপ দিয়ে পুকুরের গভীর থেকে তুলে নিয়ে আনেন টুনটুনের হিম শীতল দেহ।

 

টুনটুনকে নিয়ে যাওয়া হলো হাসপাতালে। না, টুনটুন আর নেই। ডাক্তার সাহেব বিমর্ষ হয়ে জানালেন। অত টুকুন একটা বাচ্চার নিথর দেহ দেখে তিনিও অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি। কাঁপাকাঁপা কণ্ঠে বললেন, “অনেক দেরি হয়ে গেছে”।

 

এবার ঘটল আরেকটি হৃদয়বিদারক ঘটনা। বাড়ি ফিরতে যেয়ে টুনটুনের একটি হাত নড়ে উঠল। মরদেহ নিয়ে আবার দৌড়ে সবাই হাসপাতালে। কেউ কেউ রেগে মেগে চড়াও হলেন ডাক্তারের ওপর।

 

না, এবার ইসিজি ইকো সব করে কনফার্ম করা হলো। টুনটুন বেঁচে নেই।এভাবে বাড়ির পুকুরে পড়ে প্রতিদিন কোথাও না কোথাও শিশু মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। বর্ষাকালে এসব খুব বেশি দেখা যায়। আমি সাব-সেন্টার ও হেলথ কমপ্লেক্স এ থাকাকালে এগুলো পেয়েছি।

 

কচি মুখ দেখে ডেথ সার্টিফিকেট এ সাইন করতে সত্যি খুব খারাপ লাগত তখন। শুধু ঘরের বাইরে, পুকুর বা কুয়োতে পড়ে শিশু মৃত্য হয়, তা কিন্তু না। এমনকি ঘরের ভেতর বাথরুমের বালতিতে জমিয়ে রাখা পানিতে পড়ে বাচ্চা মারা গিয়েছে সেটা ও পেয়েছি। অত্যন্ত মর্মান্তিক সে দৃশ্য।

 

দুই: একদিন খুব সকাল মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট দিপংকর সাহেব খবর পাঠালেন। স্যার, একটু আসবেন। জরুরি। আমি তখন দোতলায় কেবল রাউন্ড শুরু করেছি। নিচে ইমার্জেন্সি রুমে ঢুকতেই দেখি প্রচণ্ড ভিড় আর কান্নার আহাজারি। দলে দলে লোকজন ইমার্জেন্সি তে ছুটছে। সে এক করুণ দৃশ্য।

 

মা ছেলেকে ড্রইংরুমে রেখে রান্না ঘরে কাজ করছিলেন। একটু পরে খেয়াল হলো বাবু পাশে খেলছিল, কিছুক্ষণ হলো সাড়াশব্দ নেই, কই যে গেল। শুরু হলো তন্ন তন্ন করে খোঁজা আর এদিক ওদিক ফোন। বাড়িতে, পুকুরঘাটে। নেই, নেই, নেই। কোথাও নেই।খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ পাওয়া গেল ঘরের মধ্যেই, বাথরুমের ভেতর বালতিতে উপুর হয়ে পড়ে রয়েছে নিথর দেহ। বালতিভর্তি রাখা ছিল পানি।

 

হাসপাতালে নেয়ার পর বলা হয়ে ছিল বেঁচে নেই। কিন্ত শেষকৃত্য অনুষ্ঠান করতে যেয়ে দেখা গেল বাবুটির একটি আংগুল হঠাৎ কেঁপে উঠছে। বরফ শীতল নিথর দেহকে আবারো ভালো করে এক্সামিন করে বলা হলো, নাহ, বেঁচে নেই। সে অনেক আগেই মারা গিয়েছে। ইসিজি করেও দেখানো হলো।

 

হৃদয়বিদারক এই দুটি ঘটনার অবতারণা করেছি দুটো বিষয় নিয়ে বলতে,

এক. সচেতন করতে এভাবে অনাকাঙ্ক্ষিত শিশু মৃত্যু,

দুই.হঠাৎ করে কোনো মৃতদেহের হঠাৎ কেঁপে উঠা নিয়ে।

মৃতদেহের হঠাৎ নড়া চড়া নিয়ে অনেক ভুলবোঝাবুঝি হতে দেখা যায়। এই তো ক’দিন আগে জানাজার প্রস্তুতিকালে মৃতের কেঁপে উঠা নিয়ে পত্রিকায় খুব লেখালেখি হলো। হইচই কাণ্ড। সব দোষ চাপে ডাক্তারের উপর। তিনি ভালো করে পরীক্ষা না করেই ডেথ ডিক্লারেশন করেছেন। ঘটনাটা এ রকম, এক নবজাতক (প্রি-ম্যাচিউর বেবি) প্রসবের পর ডাক্তার দেখেন শিশুটির অবস্থা খুবই খারাপ। কান্না নেই শ্বাস ও নেই। সিভেয়ার বার্থ এস্পেক্সিয়া। অনেক চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়নি নবজাতক।

 

ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন। কিন্তু কবর দিতে গিয়ে দেখা গেল সেই প্রে-ম্যাচিউর অ্যান্ড প্রি-টার্ম বেবি নাকি কান্না করেছে, নড়াচড়া করেছে। পরে হেলিকপ্টারে করে তাকে ঢাকার একটি হাসপাতালে আনা হয়। আইসিইউতে রাখা হয়। তারপরের খবর আর জানা যায়নি।

 

এভাবে হঠাৎ মৃত্যু, হাসপাতালে, আইসিইউ’তে দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর মৃত্যু, হঠাৎ সড়ক দুর্ঘটনা বা কার্ডিয়াক কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট এ মৃত্যু কিংবা অন্য কোন কারণে আপনার কোনো স্বজন মৃত্যুবরণ করার পর শেষ অনুস্টান করতে গিয়েই দেখা গেল আপনার মৃত স্বজনের দেহটি হঠাৎ একটা ছোট কাঁপুনি দিয়ে নড়ে চড়ে উঠল!! হঠাৎ নড়ে ওঠা লাশ টিকে নিয়ে আবার ছুটাছুটি। আবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা। ইসিজি, ইকো। না তিনি মৃত। তাহলে কেনো এই মৃতদেহ ওভাবে নড়ে উঠলো। মনে জাগে বিশাল প্রশ্ন।

 

আসলে চিকিৎসাবিজ্ঞানে মৃত্যুর পর কদাচিৎ নড়ে উঠা, এই ধরনের ঘঠনাকে বলা হয় “লেজারস ফেনমেনন ( Lazarus phenomenon) বা “লেজারস সিনড্রোম /সিমটম ( Lazarus symptom)।

 

শেষ করি লেজারাস ফেনোমিনন নিয়ে সামান্য আলোচনা করে।লেজারাস শব্দটি কিভাবে এলো? একবার যিশুখ্রিস্ট সেন্ট লেজারাস নামের এক ব্যক্তিকে তার মৃত্যুর চার দিন পর পুনরায় তাকে জীবিত করেন। পরে লেজারাসকে পবিত্র আত্মার অধিকারী ধরা হয়। পবিত্র বাইবেলের ১১তম খণ্ডে এ ব্যাপারে বর্ণনা আছে। সেখান থেকেই এই ‘লেজারাস’ শব্দটি এসেছে।

 

পৃথিবী তে লেজারাস ফেনোমেনন বা মৃত্যুর পর নড়ে উঠার ঘটনার উদাহরণ খুবই কম। তিরিশ কি পঁয়ত্রিশটি হবে। সবই ইউরোপ, আমেরিকায়। সবই ছিলো মৃত, প্রানের অস্তিত্ব শনাক্ত হয়নি। ব্যতিক্রমী দু-একটা কেইস লাইফ সাপোর্ট ও নেয়া হয়েছিল। তেমন ফল পাওয়া যায়নি। আমাদের দেশে এগুলো একেবারেই বিরল।

 

‘লেজারাস ফেনোমেনন’ এর কারণ ব্যাখ্যা করা কিছুটা কঠিন। তবে কিছু হাইপোথিসিস আছে যেমন,

 

১) পজিটিভ অ্যান্ড এক্সপিরেটরি প্রেশার বা পিইইপি (সিপি আর দেয়ার সময় ফুসফুসের ভেতর জমে থাকা অত্যাধিক বহির্মুখী বায়ুর চাপ),

২) মায়োকার্ডিয়াল স্টানিং (MYOCARDIAL STUNNING) বা হার্টের কিছু অংশ সাময়িক কাজ না করা,

৩) ট্রানজিয়েন্ট এসিস্টল (TRANSIENT ASYSTOLE) বা সাময়িকভাবে হার্ট বন্ধ থাকা,

৪) পিইএ (P E A) বা পালস লেস ইলেকট্রিক্যাল একটিভিটি,

৫) হাইপারকেলিমিয়া (HYPERKALAEMIA) ববা অতিরিক্ত ইন্ট্রা সেলুলার পটাশিয়াম,

৬) ডিলেইড একশন অব ড্রাগ (DELAYED ACTION OF DRUG) অর্থাৎ শেষ মুহূর্তে ডাক্তার জীবন রক্ষাকারী যে ওষুধ পুশ করেছিলেন তা দেহে কাজ করতে দেরি হওয়া, ইত্যাদির ফলেই এমন দৈবিক ঘটনার সূত্রপাত হয়।

 

আর এমন ঘটনায় যদি কেউ ফিরেও আসেন তবে ফিরে আসা মানুষ টির প্রচণ্ড রকমের নিউরোলজিক্যাল ডিসএবিলিটিসহ নানান জটিলতা নিয়ে জীবন্মৃত হয়ে কটা দিন বেঁচে থাকা খুবই অস্বাভাবিক কিছু নয়। এতে চিকিৎসকের ডেথ ডিক্লেয়ারেশন এ কোনো গাফিলতি নেই। কারণ একজন ডেথ ডিক্লেয়ারেশন করেন পাঁচটি ভাইটাল সাইন আধাঘণ্টাব্যাপী পরীক্ষা করে অনুপস্থিত পেলে।

 

লেখক: ডা. সাঈদ এনাম, এমবিবিএস ( ডিএমসি কে- ৫২) এম ফিল (সাইকিয়াট্রি)

সাইকিয়াট্রিস্ট ও উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, দক্ষিণ সুরমা, সিলেট

 

 

 

ই-বার্তা/ডেস্ক