সুধীরের স্বপ্ন

চারিদিকে পানি আর পানি। দক্ষিণা বাতাস বইছে হু হু করে, গাছের ঢাল পালা হেলে হেলে পড়ছে, বিলের ঢেউয়ে আচঁড়ে পড়ছে সুখীদের শাণ বাধাঁ উঠানে। প্রকৃতির প্রাণে যেন দোলা লেগেছে। মনে মনে গান গাওয়া শান্ত স্বভাবের পাখিগুলোও গান ধরেছে মন খুলে। তবে, মন ভালো নেই সুখীর মায়ের।

চেয়ারে হেলান দিয়ে দূরে তাকিয়ে আছে সে। দূরে যে গ্রামটা দেখা যায়, সে গ্রামের নাম মিঠাইন। সুখীর মায়ের খুব মিঠাইনে যেতে ইচ্ছে করছে। মিঠাইনের সরদার বাড়ির রোদেলা ছিল তারের স্কুলের বান্ধবী। এখনও বিয়ে হয়নি রোদেলার। করোনার কারণে মাস্টার্সের ফাইনাল পরিক্ষা শুরু হওয়ার আগেই তাকে বাড়ি চলে আসতে হয়েছে।

বিলে যে ঢেউ উঠেছে, মিঠাইনে এখন যাওয়া প্রায় কঠিনই। তবে, তার থেকে বড় ঢেউ উঠেছে তার মনের ভেতরে, সেই ঢেউ যেন ভেঙ্গে সব চুরমার করে দিচ্ছে। একদম-ই সুখ নাই, সুখীর মায়ের মনে।

রোদেলার মোবাইল নাম্বারে কল দিয়েই হু হু করে কেঁদে উঠল সুখীর মা। কান্নার আওয়াজ শুনেই রোদেলা বুঝতে পারলো, সুখীর বাপের সাথে আজও খুব ঝগড়া হয়েছে সুকন্ঠির। বললো, শোন সুকন্ঠি, আদিম কাল থেকেই পৃথিবীতি দন্দ-সংঘাত ছিল, পৃথিবীর শেষ পর্যন্ত থাকবে। কারণ, মানুষের জীবনের সাথে এসব দন্দ কোলহ জড়িয়ে আছে নিবিরভাবে, যা কোনোভাবেই জীবন থেকে বাদ দেয়া সম্ভব না। আগের যুগের মনুষীরা সাধনা করতেন, কিভাবে জগৎ সংসারে সুখে সমৃদ্ধিতে ভরিয়ে তোলা যায়। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর তপস্যা করতেন শান্তির জন্য। যেহেতু দন্দ, সংঘাত, কোলাহল জীবন থেকে কোনোভাবেই বাদ দেয়া যাবে না, তাই কতটা দক্ষতার সাথে সেসব নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনা করা যায় তা জানা, শেখা ও বাস্তবজীবনে প্রয়োগ অতীব জরুরী। পারিবারিক বন্ধন অটুট রাখার জন্য সংঘাত ও দন্দ এড়িয়ে চলতে অবশ্যই দক্ষ ও কৌশলী হতে হবে।

আর, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় সবাই মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়, অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণে ভেঙ্গে পরে পারিবারিক কাঠামো। একটা পরিবার যখন ভেঙ্গে যাওয়ার অবস্থায় থাকে, তখন পরিবারের কর্তা ও কর্তীর ব্যবহারে, আচার-আচরণে, কথোপকথনে অনেক পরিবর্তন আসে। যেসময়টা অনেক ছাড় দেওয়ার মন মানসিকতার পরিচয় দেওয়ার দরকার। পাশাপাশি, ধৈর্য্যশক্তি আরও ব্যাপকভাবে কাজে লাগাতে হবে এসময়।

সুখীর মায়ের কান্না একটু কমছে, এপার থেকে মোবাইলে হুম, হুম বলছে এখন। ওপার থেকে তখন রোদেলা বলছে, সুখীর মা, পরিবারের বন্ধন কাঁচের মতন, একবার ভেঙ্গে গেলে তা জোড়া লাগানো যায় না। তাই সবকিছু মাথায় রেখে আবেগতাড়িত হয়ে কোনো সিধান্ত নেওয়া যাবে না। ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে সিধান্ত নিতে হবে। যদি কোনো বিষয় নিয়ে দন্দ হয়, তবে শুধু ওই বিষয় নিয়েই কথা বলতে হবে, ব্যক্তিগত আক্রমণ করা যাবে না। দন্দের বিষয়ে সাথে অন্য সমস্যা নিয়ে দন্দ আরও জটিল করা যাবে না। সবসময় ইস্যুর দিকে মনোনিবেশ করতে হবে, কত ভালভাবে তা সমাধান করা যায়। সমস্যা থাকবেই, তার জন্য সসাধানও আছে। সমাধান চিন্তা করে বের করতে হবে, সংসার ভেঙ্গে নয়। যেকোনো পরিস্থিতিতে পারিবারিক সম্পর্ক অটুট রাখতে অবশ্যই সুস্থ রুচি, মন ও মানসিকতার পরিচয় দিতে হবে। সমস্যা-সংকটা জীবনে ছিল, আছে, থাকবেই, কত ভালোভাবে তা সমাধান করা যায় তাতেই জীবনের সার্থকতা।

ঢেউ কমলে অবশ্যই যেন বাড়িতে আসবি, বলেই ফোনটা রেখে দিল, রোদেলা। ঠিক সে সময়ই, সুধীরের মা ডাক দিল, সুধীরকে। ওঠ, আর কত ঘুমাবি, লাবণিদের বাড়ি থেকে দুধ আনতে হবে। ঘুম ভেঙ্গে গেল, সুধীরের, সাথে স্বপ্নও!

লেখক: সম্পাদক, ই-বার্তা।।