‘আমি এক বাদামওয়ালা’


ই-বার্তা প্রকাশিত: ১লা মে ২০১৭, সোমবার  | দুপুর ০২:২৯ গদ্য

ফারহানা মোবিন
চিকিৎসক (স্কয়ার হাসপাতাল, ঢাকা)
রোদের তপ্ততায় পুড়ে, বৃষ্টির কাঁদা পানিতে ভিজে, ঝড়ো হাওয়ার ধূলায় ধূসরিত হয়ে, ডালি ভর্তি বাদাম নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি, আমি এক কিশোর, আমি এক বাদামওয়ালা।
কোন বস্তিতে জন্ম হয়েছে তা জানিনা, বুদ্ধি হবার পর থেকেই দেখছি, দুই বেলা দুই মুঠো ভাতের জন্য ভয়ানক হাহাকার। এই নগরীর লোকে লোকারণ্য রাস্তা গুলোর পাশে আমার ভ্রাম্যমান ব্যবসা। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকি নগরীর বিভিন্ন রাস্তা গুলোতে।
কখনো পেটে জ্বলে ক্ষুধার আগুন, কখনো বা চোখে জ্বলে স্বপ্ন ভেঙ্গে যাওয়ার ফাগুন। ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকি রাস্তার ধারে, বাদামের ডালি নিয়ে। কতো রং-বেরং এর মানুষ দেখি এই ঢাকা শহরে। কেউ পকেট মারে, কেউ চুরি করে, কেউ করে ক্ষুধার রাজ্যে বসবাস।
সকাল বেলা বাদাম বিক্রি করি স্কুলের সামনে। আমারও খুব ইচ্ছা করে স্কুলে পড়তে। কি সুন্দর লাগে ছেলে মেয়েদের এক রঙের স্কুলের ড্রেস পরা দেখতে! সবার এক সাথে ছুটি হয়। কি অপরাধ করেছি আমি জীবনের কাছে? আমারও খুব ইচ্ছা করে বাদাম বিক্রি ছেড়ে স্কুলে লেখাপড়া করতে। বাবা মায়ের হাত ধরে খোলা আকাশের নীচে হাঁটতে। কিন্তু আমিতো জানিই না, কে আমার মা কে আমার বাবা! আমি শুধু জানি, আমার পেট ভরা ক্ষুধা, আমাকে ঘর ভাড়া দিতে হবে, বুড়ো নানীর জন্য খাবার কিনতে হবে, আমার যে কেউ নেই। বুদ্ধি হবার পর থেকেই দেখছি, এই বুড়ো মানুষটা আমাকে বুকে নিয়ে বড় করেছে।
আমাকে নাকি আমার মা পলিথিনে করে (আমার জন্মের পর) রাস্তার ড্রেনে ফেলে দিয়েছিল। খুব জানতে ইচ্ছে করে, “মা আমার কি অপরাধ ছিল? যদি ড্রেনে ফেলতেই হতো, তবে কেন আমায় জন্ম দিয়েছিলে ? যদি আমাকে ছেড়ে চলে যেতেই হতো, তবে কেন রাস্তায় ফেলে দিয়েছিলে? তোমার জুতা দিয়ে আমাকে পিষে মেরে ফেলোনি কেন?”
বাদামওয়ালা হতে ভালো লাগে না মা, বাদামের ডালি নিয়ে রাস্তায় ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে আসে দুই পা, বিধ্বস্ত হয়ে আসে আমার ভবিষ্যৎ।

ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠি। স্কুল শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকি, আর দুই চোখ ভরে দেখি, স্কুলের ছেলে মেয়েদের। তাদরে জন্য তাদের মায়েরা রাস্তার ধারে বসে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা। আর আমি ঘন্টার পর ঘন্টা রৌদ্রে পুড়তে থাকি, একটা টাকা লাভের আশায়।
আমিও মানুষ। আমারও বেড়াতে ইচ্ছে করে। স্কুলে পড়তে ইচ্ছে করে, আমারও পরিষ্কার জামা পড়তে ইচ্ছে করে, মজার খাবার গুলো খেতে ইচ্ছে করে।
স্কুলের সামনে বাদাম বিক্রি শেষে চলে যাই শপিং কমপ্লেক্সের পাশে। দলে দলে মানুষ কিনতে আসে বিভিন্ন রকম জিনিস। আমি এক নীরব দর্শক। সাবার আনন্দ দেখে নীরবে ফেলি চোখের পানি। বিশ্বাস করো, তোমাদের কারো আনন্দ দেখে, আমার একটুও হিংসা হয়না।
আমিও মানুষ। আমারও পেতে ইচ্ছে করে ভালো খাবার, সুন্দর পোষাক। মাঝে মাঝে মনে হয়, বাদাম আর বিক্রি করবো না। কিন্তু কি করবো আমি ? কিভাবে চলবে আমার জীবন?
মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে হয়, একটু বসি রাস্তার ধারে। বসে থাকি বাদামের ডালি নিয়ে। কিন্তু বসে বাদাম বিক্রি করলে বেশী টাকা দিতে হয় রাস্তার নেতাদের। রাস্তার নেতা!! অর্থাৎ আমাদের মতো ভিখারীর পেটে লাথি মেরে যাদের মানিব্যাগ মোটা হয়।
দাঁড়িয়ে বাদাম বিক্রি করলে দিতে হয় কম টাকার ঘুষ। আর বসে বাদাম বিক্রি করলে গুণতে হয়, অনেক বেশী টাকা। ভ্যান গাড়ি থাকলে, চাঁদার পাল্লা হয় আরো বেশী। তারাতো রাস্তার নেতা নয়, তারা আমার মতো গরীবের কাছ থেকে চাঁদা নেয়। তারা আমার থেকেও গরীব।
নিজে ভিখারী হয়েও এই ভিখারী গুলোকে ভিক্ষা দিতে হয়। বন্ধ হোক এই ভিক্ষা দেয়া।
তোমাদের সংসদে নাকি আমাদের জন্য অধিবেশন বসে? নামীদামী নেতারা আইন বানায়, বাহবা পায়। সাংবাদিকরা ছবি তোলে। লেখকেরা লিখতে লিখতে ভারী বানিয়ে ফেলে পান্ডুলিপি। কিন্তু আমাদের জীবনের কোন পরিবর্তন হয়না ।

রৌদ্র আমাদের পুড়াতেই থাকে, বৃষ্টি আমাদের ভাঙ্গা ঘর টাকে আরো বেশী ভিজিয়ে দেয়, ঝড়ো হাওয়া আমাদের স্বপ্নগুলোকে করে তোলে আরো বেশী ধূলমিয়।
আমি এক বাদামওয়ালা। আমিও মানুষ। আমি বাঁচতে চাই, মানুষ হয়ে বাঁচতে চাই।

সর্বশেষ সংবাদ

গদ্য এর আরও সংবাদ