কাগজের ঠোস- ডাঃ ফারহানা মোবিন


ই-বার্তা প্রকাশিত: ২৬শে সেপ্টেম্বর ২০১৭, মঙ্গলবার  | বিকাল ০৪:৫০ গদ্য

জানালার পর্দা উঠানো ছিল। নফেল চুপি চুপি দেখতে গেল যে দাঁড়ানো ছেলেটা এখনো আছে কিনা? সে হতবাক হয়ে গেল, ছেলেটি এখনো রাস্তায় দাঁড়ানো। নফেল কে দেখে ছেলেটা কিছুটা আড়াল হয়ে গেল। নফেলের খুব ভয় লাগতে শুরু করল। মামমাম তো অফিসে, বাবাও অফিসে। রান্নাঘরে কাজ করছে জরিনা। বাসায় আর কেউ নায়। এই বন্দী জীবন নফেলের আর ভালো লাগেনা। টিভি দেখতেও ভালো লাগেনা। শুধু পড়া আর পড়া। এতো পড়া, ক্লাস টেস্ট আর ভালো লাগেনা।

টিংটং। হঠাৎ বেজে উঠল কলিং বেল। নফেল লাফ দিয়ে গেল দরজা খোলার জন্য। জরিদা তখন বাথরুমে গোসল করছিল। জরিনা চিৎকার করে বললঃ নফেল না চিনলে দরজা খুলোনা।

নফেল দরজার ফুটো দিয়ে দেখল পেপারওয়ালা। খুশীতে ভরে উঠল তার মন।
পেপারওয়ালাঃ ভাই পেপার আছে?
নফেলঃ আছে, বই খাতাও আছে।
পেপারওয়ালাঃ ভাই তাড়াতাড়ি করেন।
বাজারে মন্দা চলছে, ৫ কেজি বই খাতার দাম হলো ৫ টাকা। কত টাকা ঠকে গেল তা দিয়ে নফেলের কোন চিন্তা হলো না। নফেল টাকার কথা চিন্তা করল না। স্কুলের জরুরী কিছু বই পত্রও বিক্রি করে দিল। পেপারওয়ালা কাগজের ডালি উঁচু করে মাথায় উঠাতে যেয়েই নফেল দেখল সেই ছেলেটা। বিস্ময় আর ভয়ে নফেলের হাত ঘেমে উঠল। পেপারওয়ালার দাড়িপাল্লা হাতে নিয়ে সিড়ি দিয়ে ছেলেটা নামছে। জরিনা বাথরুমেই আছে।

নফেল পেপারওয়ালার পিছু নিল। বেলা দুপুর তিনটা। হাটতে হাটতে পেপারওয়ালা পৌছে গেল রায়ের বাজারের বস্তিতে। ছোট্ট খড়ের ঘর। টিনের চালা উপরে। নীচে কাদা, পানি, স্যাঁতসেতে গন্ধযুক্ত ঘর। রাস্তা থেকে ঘরে যাবার জন্য দুটি বাঁশ দিয়ে তৈরী পথ। তাতে পেপারওয়ালা আর সেই ছেলেটা দৌঁড়ে পার হল। ঢুকে গেল ছোট একটা ঘরে। দরজায় নোংরা চট ঝুলানো। নফেল বাঁশের উপর দিয়ে পার হতে পারল না। পা ফসকে পড়ে গেল নোংরা কাদা পানিতে। দুই পা ঢুকে গেল কাদাতে। ভয়ে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করল নফেল।

দৌঁড়ে ঘর থেকে বের হল ‘জালা’। টেনে তুলল ‘নফেলকে’। ঘরে নিয়ে পা মোছার জন্য কাপড় দিল, কাদা ধোয়ার জন্য পানি দিল। বাকা হয়ে যাওয়া পুরানো হাড়িতে ছিল পানি।
জালা- নফেল, তুমি আমাদের পিছু কিয়ের লাগি আইছো?’
নফেল- তুমি আমার নাম জানো?
জালা- হ, জানি। তুমি তোমাগো জানালা দিয়া বই, খাতা, ফালাও, হ্যাতে তুমার নাম লিখন থাকে। তুমি ধানমন্ডির ইংরাজী স্কুলেও পড়ো। এই দ্যাখো, আমার কাছে তুমার বই, খাতা, বইয়ের ছেড়া পাতা। নফেল ভয় আর বিস্ময়ে আরো বেশী নীল হয়ে উঠল। সর্বনাশ মামমাম যদি জেনে যায় যে এগুলো আমি জানালা দিয়ে ফেলেছি, তাহলে কি হবে?
নফেল- বই, খাতা আর বই এর ছেড়া পাতা দিয়ে তুমি কি


করো?
জালা- আমরা গরীব। স্কুলেয় পড়বার ট্যাকা নায়। একদিন পেপার বিক্রির খোঁজে তুমাগো বাড়ীর কাছে গেছিলাম। আমার এক বন্ধু কইল, তুমি নাকি জানাল দিয়ে বই, খাতা, বইয়ের পাতা ফালাও। বিক্রির আশায় তুমার বাড়ীর নীচে প্রতিদিন ঘুরতাম। তয়, অহন বিক্রির আশায় না। পড়বার আশাতেও ঘুরি।
নফেল- পড়বার আশা?
জালা- দ্যাখো, তুমার ছেড়া বই এর পাতাগুলা অহন বই হয়া গ্যাছে। আমাক পড়তে বড়ই ইচ্ছা করে। তুমার ইংরাজী বই গুলান পড়তে পারি না, বাংলা অল্প কিছু পরি।
নফেল- তোমাকে কে পড়া শিখিয়েছে?
জালা- আমার এক বন্ধু ছিন্নমূল স্কুলে যায়। হ্যারো পড়নের খুব শখ। হেই আর আমি সারা শহর থেইকা কাগজ কুড়াইয়া ঠোস বানাই। ঠোস হইল কাগজের প্যাকেট।
পেপারওয়ালা- হ্যারে কত মারসি বই এর পাতাগুলা দিয়া ঠোস বানানোর লাগি। ঠোস বানাইলে বিক্রি করি ট্যাকা পাই। শয়তানে লেখাপড়া করার লাগি পাগল। গরীবের কিসের লেহাপড়া। আমগো জীবন হইলো পেপার বেচা আর ঠোস বানানোর জন্যি।

নফেল বিস্ময় নিয়ে কথাগুলো শুনছিল। তার পড়তে ভালো লাগেনা তাই বই এর পাতা ছিড়ে জানালা দিয়ে বই ফেলে দেয়, আর এদের জীবন কি কষ্টের! দুঃখে নফেল কাঁদতে শুরু করল। কুড়িয়ে আনা কাগজ দিয়ে জীবন চলে কিভাবে? একটা ছোট্ট কিটকাট চকলেটের দামও তো ত্রিশ টাকা। কষ্টে নফেলের কান্না পেয়ে গেল। নফেল ঠিক করল সে আর কোনদিন বই এর পাতা ছিড়বেনা। মন দিয়ে লেখাপড়া করবে।
জালা- ভাই, তুমি কাইন্দোনা।
রিক্সাতে করে জালা আর নফেল রওনা দিল। নফেলের বাসার সামনে প্রচন্ড ভীড়। বাসাতে পৌছা নফেল চিৎকার দিয়ে বলল- কেউ ওকে মেরোনা, ও আমার বন্ধু, ছেলেধরা নয়।
নফেল হারিয়ে গেছে ভেবে নফেলের মামমাম (মা) অজ্ঞান হয়ে যায়। জ্ঞান ফিরে জড়িয়ে ধরে নফেলকে। সব ঘটনা খুলে বলে সবাইকে। নফেলের বাবা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয় জালাকে। নফেলের কথায় তাকে প্রতি মাসে দেয় এক হাজার টাকা দেয় যেন জালার লেখাপড়া করতে কষ্ট না হয়।

দুইদিন পরে হঠাৎ ভোরবেলা জানালার পর্দা সড়ায় নফেল। মুহূর্তে তার চোখে ফুটে ওঠে আনন্দের ঝিলিক। জালা স্কুলে যাবার জন্য ব্যাগ কাধে দাঁড়িয়ে। হাত নেড়ে বিদায় জানায় নফেলকে। নফেল পুরানো বই সব জমাতে থাকে জালার জন্য। জালাকে আর বানাতে হয়না কাগজের ঠোস। নফেল আর জালা দুজনেই পড়ালেখা করতে থাকে মন দিয়ে।

ডাঃ ফারহানা মোবিন
এমবিবিএস (ডি ইউ)
রেসিডেন্ট মেডিকেল অফিসার, স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগ
স্কয়ার হাসপাতাল, ঢাকা।
এম.পি.এইচ, সিসিডি (বারডেম হাসপাতাল)
সি-কার্ড (ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন)
কোয়ান্টাম গ্রাজুয়েট (কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন)

সর্বশেষ সংবাদ

গদ্য এর আরও সংবাদ