যৌনবাহিত রোগ নিয়ে চালানো ৬টি গোপন পরীক্ষা


ই-বার্তা প্রকাশিত: ১লা নভেম্বর ২০১৭, বুধবার  | সন্ধ্যা ০৬:২৫ আন্তর্জাতিক

ই-বার্তা।। যৌনবাহিত রোগ নিয়ে আজ পর্যন্ত অনেক গবেষণা হয়ে আসছে। এখনো হচ্ছে, অতীতেও হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে। কিন্তু গোপন ভাবে এ বিষয় নিয়ে পরীক্ষা হয়েছে এটা নিশ্চয়ই আমরা সবাই জানি না। আসলেও তা হয়েছে। যৌন বাহিত এমন ছয়টি রোগ নিয়ে গোপন পরীক্ষা- নিরিক্ষা সম্পর্কে জানাতে চাই আজকের এই লেখায়।

টাস্কেজী সিফিলিস এক্সপেরিমেন্ট
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আলাবামা অঙ্গরাজ্যের ম্যাকন কাউন্টিতে ১৯৩২ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত প্রায় ৪ দশক ধরে চলেছিলো একটি পরীক্ষা। এ পরীক্ষায় সেখানকার সিফিলিসে আক্রান্ত ৩৯৯ জন এবং ২০১ জন সুস্থ ব্যক্তি অংশ নেয়, যাদের সবাই ছিলো কৃষ্ণাঙ্গ। লোকগুলো তাদের অসুখ সম্পর্কে তেমন কিছুই জানতো না। তাদেরকে বলা হয়েছিলো তাদের রক্ত দূষিত হয়ে গিয়েছে এবং তাদের এ চিকিৎসা মাস ছয়েক সময়কাল ধরে চলবে। এ পরীক্ষায় যারা অংশ নিয়েছিলো তাদেরকে বিনামূল্যে খাদ্য ও চিকিৎসা সেবা এবং মৃতদেহের শেষকৃত্যানুষ্ঠানের ইন্স্যুরেন্সের নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছিলো।
মূলত পেনিসিলিনের কার্যকারিতা এবং অন্যান্য আরো পদ্ধতি নিয়েই পরীক্ষা চালানো হচ্ছিলো। ষাটের দশক থেকেই জনগণের মনে ক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করে, অভিযোগ আসতে থাকে পরীক্ষকদের বিরুদ্ধে। অবশেষে ১৯৭২ সালে পিটার বাক্সটন নামক যুক্তরাষ্ট্রের পাবলিক হেলথ সার্ভিসের যৌনব্যাধি নিয়ে তদন্তকারী এক কর্মকর্তা এ বিষয়ে বিস্তারিত সংবাদ মাধ্যমের কাছে ফাঁস করে দিলে পরীক্ষার ইতি টানতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ। ততদিনে ৬০০ জনের মাঝে বেঁচে ছিলো মাত্র ৭৪ জন।

ডাক্তার হেইম্যানের গনোরিয়া পরীক্ষা
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ৪০ জনের মতো মানুষের খোঁজ পাওয়া গিয়েছিলো, পরীক্ষা করতে গিয়ে যারা গনোরিয়াতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। বিভিন্নভাবেই একজন মানুষকে গনোরিয়ার জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত করা হতো। এর মাঝে একটি পদ্ধতি ছিলো কাঠির প্রান্তে গনোরিয়ার জীবাণু লাগিয়ে তা একজন ব্যক্তির চোখে ঘষে দেয়া। ১৮৯৫ সালে ডাক্তার হেনরি হেইম্যান মানসিক ভারসাম্য হারানো দুটি ছেলে এবং যক্ষার চূড়ান্ত পর্যায়ে থাকা এক ব্যক্তির উপর গনোরিয়া নিয়ে পরীক্ষা চালিয়েছিলেন। অবশ্যই এগুলো হয়েছিলো আক্রান্তদের অজান্তে। পরবর্তীতে যখন জানা গেলো যে, বানরও এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে, তখন থেকে মানুষের উপর এ রোগের পরীক্ষানিরীক্ষার হার কমতে শুরু করে।

এইডস চিকিৎসার প্লাসিবু ট্রায়াল
নব্বইয়ের দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যেসব গর্ভবতী নারীরা এইডসে আক্রান্ত ছিলেন, তারা গর্ভধারণের শেষ ১২ সপ্তাহে AZT নামে একটি ওষুধ নিতেন যেন রোগের প্রভাব তাদের সন্তানের উপর না পড়ে। তবে সমস্যা হলো, প্রতি মায়ের জন্য খরচ পড়তো ১,০০০ ডলার করে, যে ব্যয় অনেকের পক্ষেই বহন করা ছিলো বেশ কষ্টসাধ্য এক ব্যাপার। তাই সে সময় দেশটির সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোলের অর্থায়নে আফ্রিকা মহাদেশ, থাইল্যান্ড ও ডোমিনিকান রিপাবলিকে এইডস আক্রান্ত গর্ভবতী নারীদের উপর পরীক্ষা চালানো হয়, উদ্দেশ্য ছিল কম খরচে একই চিকিৎসার কোনো উপায় খুঁজে বের করা।
১২,২১১ জন গর্ভবতী নারীর উপর চালানো হয়েছিলো পরীক্ষাটি। কাউকে যুক্তরাষ্ট্রের নারীদের মতোই সমপরিমাণের ডোজ দেয়া হয়েছিলো, কারো ডোজের পরিমাণ ছিলো তার থেকে কম, আবার কাউকে দেয়া হয়েছিলো প্লাসিবু (রোগ নিরাময়ের বদলে কেবলমাত্র রোগীকে সান্ত্বনা দেয়ার উদ্দেশ্যে দেয়া ওষুধের বদলে অন্য কিছু)। বিতর্কের জন্ম নেয় এই প্লাসিবুকে ঘিরেই। কারণ যে নারীরা প্লাসিবু গ্রহণ করেছিলেন, তারা নিজেরাও জানতেন না যে তাদের সাথে এমন প্রতারণা করা হচ্ছে। এ প্রোগ্রামের আওতায় জন্ম নেয়া প্রায় ১,০০০ শিশু জন্ম থেকেই এইডসে আক্রান্ত ছিলো। অবশ্য মন্দের ভালো বলতে গবেষকেরা এটা বের করতে পেরেছিলেন যে, তুলনামূলক কম ডোজের AZT প্রয়োগ করেও এইডস আক্রান্ত মায়ের দেহ থেকে গর্ভের সন্তানকে সুরক্ষা দেয়া সম্ভব।

ডাক্তার নগুচির সিফিলিস এক্সপেরিমেন্ট
১৯১১-১২ সালে স্বজাতির উপর সিফিলিস নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষার জন্য সবচেয়ে বেশ স্মরণীয় হয়ে আছেন ডাক্তার হিদেয়ো নগুচি। নিউ ইয়র্কে অবস্থিত রকফেলার ইন্সটিটিউটের জন্য এ পরীক্ষাটি করেছিলেন তিনি। পরীক্ষার জন্য সর্বমোট ৫৭১ জন মানুষকে স্থানীয় বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে আনা হয়েছিলো, সেই সাথে আনা হয়েছিলো এতিম শিশুদেরও। এদের মাঝে ৩১৫ জন আগে থেকেই সিফিলিসে আক্রান্ত ছিলো।
পরীক্ষায় অংশ নেয়া প্রত্যেকের দেহে সিফিলিসের জীবাণু প্রবেশ করানো হয়েছিলো। সিফিলিসের প্রভাবে তাদের ত্বকে কেমন প্রভাব পড়ে সেটা দেখাই ছিলো এর মূল উদ্দেশ্য। একসময় যখন বিষয়টি নিয়ে জানাজানি হয়, তখন চারদিকে সমালোচনার ঝড় ওঠে। জানা যায়, জীবাণু প্রবেশ করালেই একজন ব্যক্তি সিফিলিসে আক্রান্ত হবেনে না এটা প্রমাণ করতে ডাক্তার নগুচি নিজের দেহেই সিফিলিসের জীবাণু প্রবেশ করিয়েছিলেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তিনি নিজেই ১৯১৩ সালে এ রোগে আক্রান্ত হয়ে যান।
বিতর্কিত এ পরীক্ষার মাধ্যমে নগুচি দেখিয়েছেন, সিফিলিস পর্যায়ক্রমে প্যারালাইসিসের দিকে নিয়ে যেতে পারে একজন মানুষকে। পরবর্তীকালে এজন্য নোবেল পুরষ্কারের জন্যও মনোনীত হয়েছিলেন তিনি।

উগান্ডায় এইডসের পরীক্ষা
Viramune নামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি ওষুধ ব্যবহৃত হয় এইডসের চিকিৎসার নিমিত্তে। ১৯৯৭ সালে এ ওষুধটি নিয়েই Nevaripine নামে উগান্ডায় পরীক্ষামূলকভাবে কাজ শুরু করা হয়েছিলো। সেই পরীক্ষার মূল লক্ষ্য ছিলো এই ওষুধের কেবলমাত্র একটি ডোজ মা থেকে গর্ভের শিশুতে এইডসের সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে কতটুকু কার্যকর তা যাচাই করা। এর বেশি ডোজ লিভারের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে সেই পথে হাঁটবার উপায়ও ছিলো না। পরীক্ষা থেকে জানা যায়, এই ওষুধের কারণে মা থেকে শিশুতে এইডসের সংক্রমণের হার অনেক কমে গিয়েছিলো। ফলে ২০০২ সালে বুশ প্রশাসন থেকে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের বিশাল এক বাজেট অনুমোদন দেয়া হয় যাতে করে ওষুধটি পুরো আফ্রিকা মহাদেশ জুড়েই বিতরণ করা সম্ভব হয়।
পরবর্তীকালে জানা যায়, পরীক্ষা চালনাকারীরা আসলে বেশ কিছু তথ্য গোপন করে গিয়েছিলেন। পরীক্ষা চলাকালে এতে অংশ নেয়া ১৪ জন মারা যায়। এ তথ্যটি গোপন রাখা হয়েছিলো। পাশাপাশি হাজার হাজার নারী ওষুধের ক্ষতিকর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার শিকার হয়েছিলেন। ২০০২ সালে উগান্ডার সরকার যখন এতকিছু জানতে পারে, তখনই তারা অমানবিক সেই পরীক্ষা বন্ধ করে দিয়েছিলো।

গুয়াতেমালা সিফিলিস এক্সপেরিমেন্ট
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অর্থায়নে সেখানকার কিছু চিকিৎসকের সহায়তায় ১৯৪৬-৪৮ সাল পর্যন্ত চলেছিলো গুয়াতেমালা সিফিলিস এক্সপেরিমেন্ট। এর মূল উদ্দেশ্যে ছিলো সিফিলিস নিরাময়ে পেনিসিলিন কতটা কার্যকর সেটা যাচাই করা। এ লক্ষ্যে গুয়াতেমালার সিফিলিসে আক্রান্ত পতিতাদের খুঁজে বের করে তাদের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করা হতে থাকে। সেই সাথে খোঁজখবর নেয়া হয় তাদের সাথে মিলিত হয়ে সিফিলিসে আক্রান্ত হওয়া পুরুষদের ব্যাপারেও।
সবচেয়ে দুর্ভাগা ছিলো সেখানকার বন্দী ও মানসিক সমস্যাক্রান্ত রোগীরা। কারণ এমন প্রায় ১,৩০০ জনের দেহে ইচ্ছাকৃতভাবে সিফিলিস, গনোরিয়া সহ নানা ধরনের যৌনবাহিত রোগের জীবাণু ইনজেকশনের মাধ্যমে প্রবেশ করানো হয়েছিলো। তাদের মাঝে মাত্র ৭০০ রোগী চিকিৎসা সেবা পেয়েছিলো। ফলস্বরুপ ৮৩ জনের মতো দুর্ভাগা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে এই এক্সপেরিমেন্টের অভিশাপে। তবে প্রকৃত সংখ্যা এর থেকে আরো বেশি বলেই দাবি করা হয়ে থাকে। এই এক্সপেরিমেন্ট চালনাকারীদের একেবারে শীর্ষস্থানে ছিলেন চিকিৎসক জন চার্লস কাটলার। আজকের লেখায় একেবারে শুরুতে উল্লেখ করা টাস্কেজী সিফিলিস এক্সপেরিমেন্টেও তার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিলো।
২০১০ সালে গুয়াতেমালার সিফিলিস এক্সপেরিমেন্টে আক্রান্তদের প্রতি ক্ষমাপ্রার্থনা করে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার, এ কাজকে উল্লেখ করে ‘ঔদ্ধত্যপূর্ণ ও ঘৃণ্য’ একটি পদক্ষেপ হিসেবে। কিন্তু এতেই কি সব দায় মিটে যায়!

সর্বশেষ সংবাদ

আন্তর্জাতিক এর আরও সংবাদ