গোপনে যেভাবে ত্রাণ পাবেন, গুরুদাসপুরে
তারিকুল হাসান: করোনার ক্রান্তিকালে সারাদেশে গরীব, দুস্থ, অসহায় ও নিম্নবৃ্ত্ত মানুষেরা সাহায্যে, সহায়তা ও সহযোগীতার জন্য বিভিন্ন দুয়ারে হাত পাততে পারলেও, সমাজের এক শ্রেণীর মানুষ যেন অচল ও অসহায়। ঘরে চাল-ডাল না থাকলেও কাউকে কিছু বলতে পারছে না চক্ষুলজ্জায়, পরিবারের পেটে দুমুঠো ভাত কিভাবে দিবে, সে চিন্তায় দীর্ঘশ্বাস ফেলছে বার বার। বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মত নাটোরের গুরুদাসপুরেও সেসকল মানুষের সংখ্যা কম নয়। এই দুর্দিনে অন্যদের পাশাপাশি নিম্নমধ্যবৃত্ত সেসব মানুষদের গোপনে ত্রাণ দিয়ে সহযোগিতা করছেন গুরুদাসপুরের উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিগণ।
দুই মেয়ে, বউ ও বৃদ্ধ মাকে নিয়ে ছোট্র সংসার জিয়ারুল আহমেদের (ছদ্ম নাম)। চাঁচকৈড় বাজারে ছোট একটি দোকান আছে তাঁর। সারাদিন বেঁচাকেনা করে, পাওনাদারদের সকল খরচ মিটিয়ে মোটামুটি ভালোভাবে সংসার চলছিল জিয়ারুলের। তবে, হঠাৎ নভেল করোনা ভাইরাস নামের কালো মেঘ এসে যেন অন্ধকার করে দিয়েছে তাঁর স্বচ্ছল জীবন ও জীবিকা। মাথা নিচু করে জিয়ারুল আহমেদ বলেন, “কিভাবে বলবো ঘরে চাল, ডাল নাই, তেল নেই। কিভাবে সবার সামনে দিয়ে ত্রাণ নিয়ে আসবো বাড়িতে। সন্তান ও মাকে খাইয়ে হয়তো না খেয়ে থাকতে হবে আমাদের, তবু হাত পাততে পারবো না।
নিম্নমধ্যবৃত্ত এমন আরও অনেক মানুষ আছে যাদের ঘরে চাল-ডাল ও বাজার না থাকলেও মুখ খুলতে পারছেন না। উভয়সংকটে পড়া এসব মানুষ মোবাইলে ও ফেসবুক মেসেঞ্জারে যোগাযোগ করলে গোপনে তাদের ত্রাণ সহায়তা দিচ্ছেন গুরুদাসপুরের উপজেলা চেয়ারম্যান মো: আনোয়ার হোসেন ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো: তমাল হোসেন।
গুরুদাসপুর উপজেলা চেয়ারম্যান মো: আনোয়ার হোসেন বলেন, “গুরুদাসপুর উপজেলার প্রতিটি ইউনিউয়নের ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে আমাদের ৭ সদস্য বিশিষ্ট্য টিম কাজ করছে, তারা খুজে বের করছে প্রকৃত কাদের সাহায্যে প্রয়োজন। সেসব পরিবারের তথ্য ক্রস চেক করে তাদের ত্রাণ পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। উপজেলায় যেসকল নিম্ন মধ্যবৃত্ত পরিবার আছে কিন্তু তারা প্রকাশ্যে চক্ষুলজ্জায় সাহায্য নিতে পারছেন না, তারা আমার ০১৭১৬৪০৭৭৬৩ নাম্বারে মোবাইল করে অথবা ফেসবুকের মেসেঞ্জারে (Md. Anowar Hossain) জানালে, তাদের পরিচয় গোপন রেখে তাদের বাড়িতে ত্রাণ পৌছে দিচ্ছি। যাদের আমরা ত্রাণ দিচ্ছি, তাদের একটা ডাটাবেজ তৈরি করছি, যেন পরবর্তীতে আবার তাদের সাহায্য করতে পারি।”
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: তমাল হোসেন বলেন, “গরীব, দুস্থ, অসহায় ও নিম্নবৃত্ত মানুষদের পাশাপাশি নিম্ন মধ্যবৃত্তদের সহযোগিতর জন্যও উপজেলাজুড়ে কাজ করে যাচ্ছি। যেসকল মানুষ কারো কাছে সাহায্যে চাইতে পারছেন না, তবে তাদের সহযোগিতা আসলেই দরকার, তাদের পরিচয় গোপন রেখে ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে। আমার ০১৩১৫১৭১৩৫৪ মোবাইল নাম্বারে অথবা ফেসবুক মেসেঞ্জারে (UNO Gurudaspur ) যোগাযোগ করলে পরিচয় গোপন রেখে তাদের জন্য ত্রাণের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।”
কেউ যেন একবারে দুইটা বা তিনটা ত্রাণের প্যাকেট না নেয়, অন্যদেরও পাওয়ার সুযোগ তৈরি করে দেয়, সে বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। যারা আসলেই প্রকাশ্যে সাহায্য নিতে পারছেন না, তারাই যেন এই সেবাটি পায়, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে বলে জানান, গুরুদাসপুর উপজেলার সচেতন নাগরিক, মো: শাহরিয়ার শাওন।
যেহেতু মফস্বল এলাকা, গোপনে ত্রাণ দেওয়ার জন্য হটলাইন নাম্বার দিলে তখন সবাই কল দিবে। এ সিস্টেম যাদের জন্য করা, তারা হয়তো তখন বঞ্চিত হবেন, বলে মন্তব্য করেন, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মো: আলাল শেখ।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের এ্যাডভোকেট, গুরুদাসপুরের বাসিন্দা মো: শিহাব খালেদুন শাওন বলছেন, এইটা খুবই একটা ভালো উদ্যোগ। নিম্নবৃত্ত মানুষদের পাশাপাশি অবশ্যই নিম্ন মধ্যবৃত্ত মানুষদের পাশেও দাঁড়ানো উঁচিত। কারণ, তাদের অসহায়ত্ব এখন দেখার কেউ নেই।
স্বল্প আয়ের মানুষদের ঘরের চাল যখন ফুরিয়ে যাবে, সন্তান যখন খাবারের জন্য কেঁদে উঠবে, তখন কি তারা ঘরে থাকতে পারবে? যদি ঘরে থাকতে বাধ্য হয়, খাবেন কি, বাঁচবেন কিভাবে? করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আগেই যদি না খেয়ে মরে যাই, তবে ভাইরাসের জন্য সচেতন হয়ে কি লাভ! এসব কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন গুরুদাসপুর উপজেলার মশিন্দা ইউনিউনের বামনকোলা গ্রামের বাসিন্দা রুবেল প্রামানিক (ছদ্মনাম)।
গুরুদাপুরের কল্লোল ফাউন্ডেশনের সভাপতি ও বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় যুব মহিলালীগের সহ-সভাপতি এ্যাডভোকেট কোহেলী কুদ্দুস মুক্তি বলেন, “কল্লোল ফাউন্ডেশনের প্রতিনিধি ও সেচ্ছাসেবীদের মাধ্যমে খুজে খুজে বিভিন্ন পরিবারে ত্রাণ পৌছে দিচ্ছি। আমরা কাল-পরশু হটলাইন নাম্বার আমাদের ফাউন্ডেশনের ফেসবুকে পেজে শেয়ার করবো। যারা সামনে থেকে ত্রাণ নিতে পারছেন না, হটলাইন নাম্বারে যোগাযোগ করলে এবং কল্লোল ফাউন্ডেশনের (Kollol Foundation) ফেসবুক পেজে ম্যাসেজ করলে, আমরা গোপনে তাদের ত্রাণ পৌছে দিবো।”
নাটোর ৪ আসনের এম.পি, জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি, আলহাজ্ব অধ্যাপক মো: আব্দুল কুদ্দুসের সুযোগ্য সন্তান আসিফ আবদুল্লাহ বিন কুদ্দুস (শোভন) বলেন, “আমরা ইতিমধ্যে বেশ কিছু ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করেছি। তবে, বিভিন্ন দ্রব্যের সংকটের কারণে এখন দিতে পারছি না। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী হাতে পৌছালে, প্রতিটি ওয়ার্ডের আলাদা লিস্ট ধরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে পৌছে দিয়ে আসবো। এখনও হটলাইনের মাধ্যমে ত্রাণ দিচ্ছি না তবে, নিম্নবৃত্তদের পাশাপাশি আমরা নিম্ন মধ্যবৃত্তদেরও সাহায্য করার জন্য মনোযোগ দিচ্ছি।”
নিম্ন মধ্যবৃত্তদের গোপনে সাহায্য করার এখন কোনো উদ্যোগ নেই। তবে, পরিস্থিতি যদি আরও খারাপ হয় তবে অবশ্যই সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসবে গুরুদাসপুর থানার সকল সদস্যরা বলে জানান, গুরুদাসপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি), মোজাহারুল ইসলাম।
সমাজে কিছু মানুষ আছেন, যারা ১০ দুয়ারে যেতে পারবেন না সহযোগিতার জন্য, ছাত্রলীগের নেতা কর্মীদের মাধ্যমে সেসকল পরিবার খুজে বের করে, রাতের অন্ধকারে সেসব মানুষদের পারিবারিক সহাযোগীতায় ত্রাণ সেবা পৌছে দিচ্ছেন বলে জানান উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি, আতিয়ার রহমান বাঁধন। তিনি বলেন, “আমরা পরিকল্পনা করছি, যারা সাহায্যের জন্য প্রকাশ্যে আসতে পারছেন না, তাদের গোপনে সহায়তা করার জন্য।”