হঠাৎ কেন তলব ১০ নেতাকে

চাপের মুখে পড়েছে বিএনপি। বিএনপির শীর্ষ ১০ নেতার ব্যাংক লেনদেনের হিসাব-নিকাশ নিয়ে দুদকের তদন্ত ঘিরে রাজনীতিতে নতুন আলোচনা শুরু হয়েছে। বিএনপি নেতারা বলছেন, ভোটের আগে নেতাদের চাপে রাখতেই এ কৌশল নিয়েছে সরকার।

জানা যায়, এই ১০ জনের বাইরে আরও কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার ব্যাংক লেনদেন নিয়েও একাধিক সংস্থা তদন্ত করছে। কিছুদিন আগেও দলের সম্ভাব্য একজন সংসদ সদস্য প্রার্থীর বাড়ি বিক্রির ২০ কোটি টাকা লেনদেন নিয়ে একটি সংস্থা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। হঠাৎ করে কেন এই টাকা তোলা হলো এ প্রশ্ন করা হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তার ব্যবসা-বাণিজ্যের খারাপ অবস্থা ও আগামী নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রস্তুতির কথা জানিয়েছেন।

গণমাধ্যমের খবর ধরে এইচএসবিসি, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড, ডাচ্-বাংলা, ন্যাশনাল, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, এবি ও ঢাকা ব্যাংকসহ বেশ কয়েকটি ব্যাংক থেকে সম্প্রতি ১২৫ কোটি টাকা লেনদেনের খবরও চমক সৃষ্টি করেছে বিভিন্ন মহলে। বিএনপি বলছে, এসব খবরের কোনো ভিত্তি নেই। তবে দুদকের দাবি, সব কিছুরই তদন্ত হবে। তথ্য প্রমাণিত হলেই কেবল আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অকারণে কাউকে হয়রানি করা হবে না। গতকাল দিনভর বিষয়টি নিয়ে শুধু বিএনপি নয়, অন্যান্য দলেও আলোচনা শুরু হয়েছে। সরকারি দলের মধ্যে আলোচনা ছিল, নির্বাচন পর্যন্ত এভাবেই বিএনপিকে চাপে রাখতে হবে।

বিএনপির অভ্যন্তরে ধারণা, নির্বাচন ঘনিয়ে এলে দলের অন্য সম্ভাব্য প্রার্থীরাও বিভিন্ন মামলা ও তদন্তের মুখে পড়তে পারেন। এ কারণে অনেক নেতাই পুরাতন মামলাগুলোর খোঁজ-খবর নিচ্ছেন। কেউ কেউ কথা বলছেন দলীয় আইনজীবীদের সঙ্গেও। বিশেষ করে নির্বাচনে প্রতিবন্ধকতা যেন তৈরি না হয়, সেদিকেই সবার দৃষ্টি। বিএনপির একজন সিনিয়র নেতা বলেন, একটি সংসদীয় আসনে তিনজন করে প্রার্থীর নামের খসড়া করা হয়েছে। কোনো কোনো আসনে আরও বেশি প্রার্থী রয়েছেন। সরকারি দলের মামলা-মোকদ্দমা ও অন্যান্য বিষয় বিবেচনায় রেখে প্রার্থী নিয়েও কৌশলে থাকবে বিএনপি। প্রয়োজনে প্রার্থী বদল হবে। তবুও ভোট থেকে তারা বিরত থাকবে না। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া সর্বশেষ কারাগারে বসেই দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলার সময় নির্বাচনের প্রস্তুতি রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। লন্ডন থেকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও একই রকম বার্তা দিয়েছেন। ভোটের বিষয়ে সরকারের কোনো কৌশলে পা রাখবে না বিএনপি।

এ ব্যাপারে গতকাল রাজধানীতে এক আলোচনা সভায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, যত চক্রান্তই হোক না কেন, নির্বাচনের জন্য বিএনপি প্রস্তুত। তবে সরকারি দলের প্রভাবশালী একজন নেতার মতে, চাপে থাকলে বিএনপি ভোটে যাবে না। কারণ, ভোট বর্জন করে তারা তাদের অন্য জনপ্রিয়তা রাখতে চায়।

বিএনপির শীর্ষ ১০ নেতার ব্যাংক লেনদেনের বিস্তারিত তথ্য অনুসন্ধান প্রসঙ্গে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, দুদক কাউকে রাজনৈতিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন ও হয়রানি করতে অনুসন্ধান বা তলব করে না। আর্থিক অনিয়মের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়। আমরা ব্যক্তির অপরাধকে গণ্য করি। যদি কোনো রাজনৈতিক নেতা তদন্তে নির্দোষ প্রমাণিত হন, তাহলে আমরা তাকে আইনের আওতায় আনব না।

দুদক সূত্র জানায়, প্রাথমিক তথ্য-প্রমাণে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি মির্জা আব্বাসের ঢাকা ব্যাংকের হিসাব থেকে ১১ কোটি ৫০ লাখ ও ৪ মার্চ আরও ৪ কোটি ৫০ লাখ টাকাসহ ১৬ কোটি টাকা দুই দফায় নগদ তোলা হয়। দুদক সূত্র জানায়, অভিযুক্তদের মধ্যে আবদুল আউয়াল মিন্টুর এইচএসবিসির হিসাব থেকে গত ১১ ফেব্রুয়ারি তিনটি চেকের মাধ্যমে মোট ১১ কোটি টাকা নগদ উত্তোলন করা হয়। ব্যাংকের ঢাকার শাখা থেকে ২টি চেকে তিন কোটি ৭৫ লাখ ও ৫ কোটি ২৫ লাখ টাকা একটি চেকে ব্যাংকের চট্টগ্রাম শাখা থেকে উত্তোলন করা হয়।

এ ছাড়া গত ১৫ ফেব্রুয়ারি আবদুল আউয়াল মিন্টু স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের হিসাব থেকে ২টি চেকে নগদ ৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা উত্তোলন করেন। এর মধ্যে একটি চেকে টাকা তোলা হয় ব্যাংকের কুমিল্লা শাখা থেকে। ২০ ফেব্রুয়ারি ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক থেকে তিনটি চেকের মাধ্যমে ৭ কোটি ৯০ লাখ টাকা উত্তোলন করেন তিনি। এর মধ্যে একটি চেকে ৭ কোটি ১৫ লাখ টাকা তোলা হয় ব্যাংকের খুলনা শাখা থেকে। ২৫ ফেব্রুয়ারি এইচএসবিসির ব্যাংকের হিসাব থেকে দুটি চেকে আরও ৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়। এ ছাড়া আবদুল আউয়াল মিন্টুর ছেলে তাবিথ আউয়ালের স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের হিসাব থেকে গত ১২ ফেব্রুয়ারি ১৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকা নগদ উত্তোলন করা হয়।

১৮ ফেব্রুয়ারি ন্যাশনাল ব্যাংকের হিসাব থেকে ৪ কোটি ৭৫ লাখ টাকা, ২২ ফেব্রুয়ারি একই ব্যাংকের হিসাব থেকে তোলা হয় ৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এর মধ্যে ২টি চেকের মাধ্যমে ৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয় নারায়ণগঞ্জ শাখা থেকে। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি এম মোরশেদ খানের এবি ব্যাংকের হিসাব থেকে ৪টি চেকের মাধ্যমে ১৮ কোটি টাকা উত্তোলন করা হয়। এর মধ্যে চারটি চেকের মাধ্যমে ২৫ কোটি টাকা তোলা হয়েছে নারায়ণগঞ্জ শাখা থেকে। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি মোরশেদ খানের ছেলে ফয়সাল মোরশেদ খানের স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের হিসাব থেকে ৯ কোটি টাকা তোলা হয় চারটি চেকের মাধ্যমে।

গত ৩ থেকে ১২ মার্চের মধ্যে ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে ১২টি চেকের মাধ্যমে ২১ কোটি টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। এ ছাড়া নজরুল ইসলাম খান ও হাবিব-উন-নবী খান সোহেলের হিসাব থেকে গত দুই সপ্তাহে ৭ কোটি টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। এসব তথ্য আরও যাচাই-বাছাই করার জন্য দুদক বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআরের কাছে রিপোর্ট চাইবে বলে জানা গেছে। বিএনপির এসব নেতার ব্যাংক লেনদেনের বিষয়টি তদন্ত করছে দুদক উপ-পরিচালক সামছুল আলমের নেতৃত্বে দুই সদস্যের বিশেষ একটি টিম।

ই-বার্তা/এস