এক দফা আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা দিবে বিএনপি

ই-বার্তা ।। নির্দলীয় সরকারের অধীনে আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের দাবিতে চলমান আন্দোলনকে এক দফায় পরিণত করতে চায় বিএনপি। এ বিষয়ে আগামী ১০ ডিসেম্বর ঢাকার মহাসমাবেশ থেকে সরকারকে কঠোর বার্তাও দিতে চায় দলটি। লক্ষ্য অর্জনে মহাসমাবেশকে ‘টার্নিং পয়েন্ট’ হিসেবে বিবেচনা করছেন বিএনপি নেতারা। সমাবেশ থেকে সরকারের উদ্দেশে কঠোর বার্তার পাশাপাশি এক দফার আন্দোলনের নতুন কর্মসূচিও ঘোষণা করবেন তাঁরা। একই সঙ্গে সরকারবিরোধী সব দলকে নিয়ে যুগপৎ আন্দোলনে জাতীয় ঐক্যের ‘রূপরেখা’ও ঘোষণা করা হতে পারে ওই মঞ্চ থেকে।

সমাবেশে অনেক ‘নতুন রাজনৈতিক চমক’ থাকতে পারে বলে জানিয়েছেন দলটির শীর্ষ নেতারা। জনমত নিজেদের পক্ষে প্রমাণ করতে একে স্মরণকালের বৃহৎ সমাবেশে পরিণত করতে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। যে কোনো মূল্যে এ কর্মসূচি বাস্তবায়নে দলটির শীর্ষ নেতারা বদ্ধপরিকর। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সমকালকে বলেন, অবাধ নির্বাচনের জন্য সবার আগে প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হবে এবং একটা নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। সংসদ বিলুপ্ত করতে হবে। নতুন যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসবে, সেই সরকার একটা নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করবে। আর এ দাবিতেই তাঁরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করছেন। পাশাপাশি তাঁরা সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কথা বলছেন। তাদেরকেও এ কাতারে আনার চেষ্টা করছেন। ঐক্য গড়ার কাজ চলছে। আন্দোলনের মূল দাবিগুলো রূপরেখা আকারে শিগগিরই প্রকাশ করা হবে। এর পর যুগপৎ আন্দোলনে নামবে বিএনপি।

ঢাকার মহাসমাবেশ সফল করতে ইতোমধ্যে বিভাগের প্রতিটি জেলায় প্রস্তুতি সভা শুরু করেছেন বিএনপি নেতারা। দায়িত্ব বণ্টন করা হচ্ছে। সমাবেশে নেতাকর্মীদের আসতে বাধা দেওয়ার শঙ্কায় পূর্বপ্রস্তুতি কী নেওয়া যেতে পারে- তা নিয়েও পরিকল্পনা করা হচ্ছে। সমাবেশের আগে ধরপাকড়, হামলার ঘটনা বেড়ে যেতে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন। তবে যা কিছুই ঘটুক; যে কোনো মূল্যে মহাসমাবেশকে জনসমুদ্রে পরিণত করার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। এ বিষয়ে ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশ প্রস্তুতি কমিটির প্রধান উপদেষ্টা ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস সমকালকে বলেন, এই সরকারকে জনগণ আর চায় না। এর বাস্তব প্রতিফলন ঘটছে বিএনপির প্রতিটি কর্মসূচিতে। সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে এসব সমাবেশ মহাসমাবেশে পরিণত হচ্ছে। ঢাকা মহাসমাবেশ যে কোথায় গিয়ে ঠেকবে- তা আন্দাজ করার ক্ষমতা সরকারের নেই। তারা যতই নির্যাতন করুক; বাধা দিক; জনগণের উত্তাল ঢেউ সামাল দেওয়ার ক্ষমতা সরকারের নেই।

জুলাই থেকে জ্বালানি তেল, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন জনইস্যুতে রাজপথে রয়েছে বিএনপি। আন্দোলনের প্রথম ধাপে জেলা, মহানগর, থানা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এসব কর্মসূচিতে ব্যাপক জনসমাগম ঘটিয়ে ইতোমধ্যে রাজপথের আন্দোলনে আলোচনায় উঠে এসেছে দলটি। পরের ধাপে ঢাকা মহানগরে ১৬টি সমাবেশ সফল করায় আরও উজ্জীবিত হয় তৃণমূল নেতাকর্মীরা। নতুন কর্মসূচিতে ১০টি বিভাগীয় গণসমাবেশ কর্মসূচি পালন করছে তারা। বুধবার চট্টগ্রামে সমাবেশের মধ্য দিয়ে শুরু হয় এ কর্মসূচি। আজ ময়মনসিংহ বিভাগে এ গণসমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী- ২২ অক্টোবর খুলনায়, ২৯ অক্টোবর রংপুর, ৫ নভেম্বর বরিশাল, ১২ নভেম্বর ফরিদপুর, ১৯ নভেম্বর সিলেট, ২৬ নভেম্বর কুমিল্লা, ৩ ডিসেম্বর রাজশাহীতে সমাবেশ হবে। দুই মাসের এ কর্মসূচি ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় মহাসমাবেশের মধ্য দিয়ে শেষ হবে।

বিএনপির সিনিয়র নেতারা জানান, দুই মাসব্যাপী বিভাগীয় সমাবেশের পর মূল দাবি নির্দলীয় সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন আদায়ে সরকার পতনের যুগপৎ আন্দোলনে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে তাঁদের। জনসম্পৃক্ত এসব সমাবেশ সফলভাবে সম্পন্ন হলে নেতাকর্মী ছাড়াও সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি বার্তা যাবে। তাদের মধ্যে আস্থা ও গতি ফিরে আসবে। তাই আন্দোলন বিষয়ে জনমত তৈরিতে এসব কর্মসূচিকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। বিভাগীয় সমাবেশ কর্মসূচি বাস্তবায়নের পাশাপাশি সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় দফা সংলাপ শেষ করতে চান তাঁরা। এসব সংলাপে যুগপৎ আন্দোলনের প্রধান দাবিগুলো চূড়ান্ত করা হচ্ছে। এর পর সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের সূচনা করতে চান তাঁরা বিএনপির বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতা জানান, ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশকে সফল করতে তাঁরা বদ্ধপরিকর। এ সমাবেশ থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আসতে পারে। যুগপৎ আন্দোলনের অনেক দিকনির্দেশনা দেওয়া হতে পারে। দেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আরও অনেক কিছু ঘটতে পারে এই সমাবেশ ঘিরে।

দলটির নেতারা আরও বলেন, চলমান বিভাগীয় গণসমাবেশ থেকে সরকারবিরোধী এক দফার আন্দোলনের ভিত গড়তে চান তাঁরা। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে জনগণকে সম্পৃক্ত করে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে এসব কর্মসূচিকে গুরুত্ব দিচ্ছে দলটি। এ জন্য সমাবেশগুলোতে সব পর্যায়ের নেতাকর্মী এবং সাধারণ সমর্থকদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন এলাকায় প্রস্তুতি সভা, ইউনিয়ন পর্যায়ে উঠান বৈঠক, কর্মী সভার মতো কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। বিভাগীয় সমাবেশ ঘিরে আশপাশের জেলাতে দলীয় কর্মী-সমর্থকের পাশাপাশি বিএনপির শুভাকাঙ্ক্ষীদের মধ্যেও যাতে উদ্দীপনা তৈরি হয়, সে চেষ্টা করা হচ্ছে। অবশ্য এসব কর্মসূচি শেষ পর্যন্ত কতটা শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হবে- তা নিয়েও সংশয়ে আছেন দলটির নেতারা। তাঁরা মনে করছেন, বিএনপির শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে যেভাবে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ বাড়ছে, তা সরকারকে বেশ চাপে ফেলেছে। বিশেষ করে চট্টগ্রামের সমাবেশে ব্যাপক উপস্থিতি এবং একই দিন গাইবান্ধা উপনির্বাচন স্থগিত ঘোষণায় সরকার আরও চাপে পড়েছে। এতে সরকারও চেষ্টা করছে, যাতে এসব সমাবেশে কম লোকসমাগম ঘটে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বাধা দেওয়া হবে না বলে সরকার মুখে যত কিছুই বলুক- তা বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না বিএনপি নেতাদের।

রাজপথের প্রধান বিরোধী দলটির নেতারা অভিযোগ করেন, চট্টগ্রামের সমাবেশে পথে পথে বাধা ও বাড়িতে পুলিশি হয়রানি করেছে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা। এর পর চট্টগ্রামে বিগত ১০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। দলীয় নেতাকর্মী ছাড়াও সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে সমাবেশের মাঠ ছাড়িয়ে আশপাশের রাস্তা ভরে যায়। ময়মনসিংহের সমাবেশেও ইতোমধ্যে বাধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। ঢাকার সমাবেশে বাধা দেওয়া হবে; নেতাকর্মীকে আসতে দেওয়া হবে না; গাড়ি বন্ধ করে দেওয়া হবে; প্রত্যেক নেতাকর্মীর বাড়িতে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী গিয়ে হুমকি দেবে; ভাঙচুর করবে, হামলা করবে- এসব বিষয় সামনে রেখেই তাঁরা পরিকল্পনা গ্রহণ করছেন। বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম জানান, যতই বাধা দেওয়া হোক; ঢাকার মহাসমাবেশ ঐতিহাসিক সমাবেশে পরিণত হবে। সেই প্রস্তুতি তাঁদের রয়েছে।

দলটির নেতাকর্মীর মতে, জুলাই থেকে শুরু হওয়া আন্দোলনে ইতোমধ্যে পাঁচজন নেতা নিহত হয়েছেন। দেশের অনেক স্থানে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীর হামলা, পুলিশের বাধা ও সংঘর্ষে অনেক নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। এসব ঘটনার পরও দমে যায়নি দলটির তৃণমূল। বরং আরও বেশি সাহস নিয়ে তারা কর্মসূচিতে ফিরছে। এবারের আন্দোলনকে পুরোপুরি সফল করতে নিত্যনতুন কৌশল নেওয়া হচ্ছে। কর্মসূচি বাস্তবায়নে ব্যর্থ হলে, অনীহা প্রকাশ পেলে তাৎক্ষণিক সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি আগামীতে মূল্যায়ন বিষয়ে সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে। ফলে এলাকাভিত্তিক কোন্দল, সাংগঠনিক দুর্বলতা থাকলেও কর্মসূচি বাস্তবায়নে নেতাকর্মীরা একাট্টা।