যেভাবে ভয়াবহ নির্যাতন চলে বুয়েটের হলে

ই- বার্তা ডেস্ক।।   বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার পর আবারও আলোচনায় উঠে এসেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের টর্চার সেলের কথা।

বুয়েটের গেস্টরুম, ২০১১ ও ২০০৫ নম্বর রুমে চরম নির্যাতন চলতো বলে জানিয়েছেন সেখানকার দু-জন সাধারণ শিক্ষার্থী।

বৃহস্পতিবার একান্ত কথা হয় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ( বুয়েট) এই দুই শিক্ষার্থীর। তাদের একজন বুয়েটের শেরেবাংলা হলের ১৭ ব্যাচের, আরেকজন একই হলের ১৮তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাদের দেয়া বর্ণনায় উঠে এসেছে ভয়াবহ নির্যাতনের চিত্র।

১৭ ব্যাচের শিক্ষার্থী বলছিলেন, ‘২০১৮ সালের ১৪ ডিসেম্বর বুয়েট অডিটরিয়ামে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের একটি অনুষ্ঠান ছিল। সেখানে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের তখনকার সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী (সম্প্রতি বহিষ্কৃত) উপস্থিত ছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে হলের সবাইকে থাকতে বলা হয়েছিল। অনেকে গিয়েছিল, অনেকে আবার পড়াশোনার জন্য যেতে পারেনি।’

‘যারা অনুষ্ঠানে যায়নি, সেদিন রাতে এমন ৫০-৬০ জনকে হলের গেস্টরুমে ডেকে নেয়া হয়। সবাইকে চড়- থাপ্পড়, এলোপাতাড়ি কিল-ঘুষি দেয় ফুয়াদ মুনতাসীর। এরপর সবাইকে ছাদে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আবারও মারধর করে রাফিদ, সকাল ও বিটু।’

ওই ছাত্র বলেন, ‘ছাদে ও গেস্টরুমে যাদের মারধর করে আমি তাদের একজন।’

‘রাফিদ, বিটু ও সকাল কথায় কথায় শিক্ষার্থীদের ২০১১ নম্বর রুমে নিয়ে পেটাতো। যেমন বড় ভাইদের সালাম দিসনি কেন? বড় ভাইদের সম্মান করিস না কেন? ঊনিশ থেকে বিশ হলেই মারধর করতো।’

১৮ ব্যাচের শিক্ষার্থী বলছিলেন, ‘বর্তমানে বুয়েটের সবচেয়ে জুনিয়র ব্যাচ হলো- ১৮ তম ব্যাচ। আমাদের র‍্যাগিংয়ের জন্য ১৭ তম ব্যাচের ছাত্রলীগের সদস্য নাহিয়ান, শামীম বিল্লাহদের দায়িত্ব দেয় ছাত্রলীগ। ওরা ইচ্ছামতো রুমে ডেকে নিয়ে র‍্যাগ দিতো।’
‘কথা না শুনলে তোদের মেরে মাটিতে পুঁতে ফেলবো, কেউ জানবেও না,’-এমন কথা বলতো।’

এ শিক্ষার্থী বলেন, ‘মূলত রাগিং এবং নির্যাতন করা হতো হলের ২০১১ এবং ২০০৫ নম্বর রুমে। ২০১১ নম্বর রুমে থাকত সকাল, অমিত সাহা, রাফিদ ও প্রত্যয় মোবিন। ২০০৫ নম্বর রুমে চারজনের সিটে একাই থাকতো মুন্না।’

যেভাবে হতো নির্যাতন

১৮তম ব্যাচের ওই শিক্ষার্থী বলেন, ‘র‍্যাগিংয়ের জন্য আমাদের রুমে ডেকে নিয়ে এক পায়ে দাঁড় করানো হতো, কান ধরে দাঁড় করানো হতো, চেয়ার ছাড়া চেয়ারে বসার ভান করতে বলা হতো, মাটিতে বসে দুই পায়ের ফাঁক দিয়ে কান ধরে মুরগি হতে বলা হতো। কারও ওপর বেশি ক্ষোভ থাকলে তাকে স্ট্যাম্পের ওপর বসানো হতো।’

“যদি কেউ দীর্ঘক্ষণ দাঁড়াতে গিয়ে বসে পড়ে যেত তখন তাকে মারধর করা হতো এবং বলা হতো, ‘মরে গেলেও করতে হবে’।’’

অভিযোগ করে কোনো লাভ হতো না

১৭তম ব্যাচের ওই বলেন, ‘আমরা কয়েক বছর ধরে এসব রাগিং দেখছি। কেউ কখনও কারও কাছে অভিযোগ করার সাহস দেখায় না। কারণ, ছাত্রকল্যাণ বিভাগ কোনো কিছুই করতে পারে না।’

“আবরারের মৃত্যুর পর ওইদিন রাতেই ছাত্রকল্যাণ পরিচালক (ডিএসডব্লিউ) মিজানুর রহমান শেরে বাংলা হলে আসেন। এসে উনি আমাদের বলেন, ‘তোমরা এতজন আর ছাত্রলীগের কয়জনকে কিছু করতে পারো না? তার কথায়ই স্পষ্ট হয় যে তার কোনো পাওয়ার (শক্তি) নেই। এ বিভাগটি পুরো বাতাসের মতো। তাদের কোনো মূল্য নেই। সাধারণ ছাত্র যদি কোনো অপরাধ করে- যেমন পরীক্ষায় নকল করে, তখন তারা তাকে ছয় মাস বা এক বছরের জন্য বহিষ্কার করেন। এর চেয়ে বেশি আর কোনো কাজ করে না ডিএসডব্লিউ।”

আবরার হত্যার তিনদিন আগে আরেক নির্যাতন

১৭তম ব্যাচের ওই শিক্ষার্থী জানান, আবরার ফাহাদকে মারার তিনদিন আগে ২০১১ নম্বর রুমে আরেকটি নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। ১৮তম ব্যাচের সিয়াম নামের এক ছাত্রকে পাঁচতলা থেকে দোতলার ২০১১ নম্বর রুমে নিয়ে আসার চেষ্টা করছিলেন ছাত্রলীগের কর্মীরা।

‘প্রথমে সিয়াম তার রুম না খুলে ডিএসডব্লিউকে ফোন দিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। সিয়ামকে রুম থেকে টেনে হিঁচড়ে পাঁচতলা থেকে দোতলার ২০১১ নম্বর রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন রাফিদ।’

তাদের দেখে রাফিদ বলেছিলেন, ‘এই দুইজনকে আনতে দেরি হয়েছে কেন? ওরা না আসতে চাইলে নিয়ে আসলি কেন? পাঁচতলা থেকে নিচে ফেলে দিলেই হতো।’

ওই শিক্ষার্থী আরও জানান, অনেকে এ নির্যাতন সইতে পেরেছেন। তবে আবরার ভাই পারেননি, তাই চলে গেছেন।’

রোববার (৬ অক্টোবর) দিবাগত মধ্যরাতে বুয়েটের সাধারণ ছাত্র ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ফাহাদকে শেরেবাংলা হলের দ্বিতীয় তলা থেকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে যান। সোমবার (৭ অক্টোবর) সকাল সাড়ে ৬টার দিকে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

সোমবার দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে মরদেহের ময়নাতদন্ত শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে ঢামেক ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান ডা. মো. সোহেল মাহমুদ বলেন, বাঁশ বা স্ট্যাম্প দিয়ে পেটানো হয়ে থাকতে পারে বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদকে। এর ফলেই রক্তক্ষরণ বা পেইনের (ব্যথা) কারণে ফাহাদের মৃত্যু হয়েছে।

তিনি বলেন, ফাহাদের হাতে, পায়ে ও পিঠে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। এ আঘাতের কারণেই তার মৃত্যু হয়েছে। আঘাতের ধরন দেখে মনে হয়েছে ভোঁতা কোনো জিনিস যেমন- বাঁশ বা স্ট্যাম্প দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। তবে তার মাথায় কোনো আঘাত নেই। কপালে ছোট একটি কাটা চিহ্ন রয়েছে।