ট্রানজিট গেটে বাংলাদেশ

আশরাফুজ্জামান মণ্ডল

এক

বিংশ শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত পরাশক্তি অর্থনৈতিক ঘাতকদের শক্ত ধারণা ছিল অর্থনীতিতে সর্বোচ্চ সফলতা অর্জনের পেছনে মোক্ষম ৩টি উপাদান হচ্ছে সংশ্লিষ্ট দেশের খনিজ সম্পদ এবং বিশাল আয়তনের রাষ্ট্রীয় স্থল ও জল সীমানা। ফলে এসব বিষয় নিয়ে ক্ষমতাবান রাষ্ট্রগুলো ক্ষমতাহীনদের ওপর যুদ্ধ, বিরোধীমুখ হত্যা, সেনা অভিযান, ধর্ষণ, গণহত্যা চালিয়ে নিরীহ কিন্তু প্রাকৃতিক সম্পদে ধনী দেশ দখল থেকে শুরু করে হেন কোন কাজ নেই যা করেনি। সত্তরের দশকের শুরু এবং শেষের দিকে পূর্ব এশিয়া এবং ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোই মূলত সামরিক এবং অর্থনৈতিক ভাবে পৃথিবীর সর্বোচ্চ শক্তিধর মার্কিন আগ্রাসনের শিকার হয়েছে। এসময় মার্কিন স্বার্থের সামান্য এদিক ওদিক হওয়ায় গুয়েতেমালার আর্বেঞ্জ, চিলির সাল্ভাদর আলেন্দে, পানামার ওমর তোরিজো এবং ইকুয়েডরের রোলমে হাইদোসহ বিপুল জনপ্রিয় অনেক প্রতাপশালী শাসকদের হয় প্লেন ক্র্যাশ নতুবা সিআইএ’র গোপন প্রশিক্ষিত বাহিনী শৃগাল বিষ প্রয়োগ অথবা যেকোন উপায়ে হত্যা করেছে। আর এসব কাজ করতে গিয়ে মার্কিন সরকারের নীতি ছিল অনেকটা ওপেন সিক্রেট ব্যাপার।  (মধ্যপ্রাচ্যে এখনো সে প্রক্রিয়া চলমান। তবে মধ্যপ্রাচ্যে সংকটের পেছনে বহুমুখী কারণ জড়িত) তবে নিকট ভবিষ্যতে উল্লেখিত তিনটি বিষয়ের একটি অর্থাৎ জলভাগ ছাড়া বাঁকি দুটি খনিজ সম্পদ এবং স্থল আয়তন নিয়ে বড় ধরণের রক্তপাত হওয়ার সম্ভাবনা নতুন শতাব্দীর শুরুতে ক্রমশ কমতে শুরু করেছে । সম্পদ বলতে নতুন ধারণায় এখন স্পষ্ট শীর্ষ অবস্থান দক্ষ মানবশক্তির। যে ব্যাপারটিতে বড় উদাহরণ সৃষ্টি করেছে দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়ার এবং সিঙ্গাপুরের মত নব্য উত্থানবাদী রাষ্ট্রের বিপরীতে প্রাকৃতিক সম্পদে ভরা নাইজেরিয়া এবং জিম্বাবুয়ের বৃহত্তর পতন।  দুর ভবিষ্যতে হয়তো বা দক্ষ মানব শক্তি নিয়েই কখনো যুদ্ধ বাধবে কিনা পীড়িত বিশ্বব্যবস্থায় সে সন্দেহ করা মোটেও বাড়াবাড়ি হবে বলে আপাতত মনে করছি না।

দুই

বিশ্ব বাণিজ্যে অংশীদারত্বের ক্ষেত্রে ছোট ছোট রাষ্ট্রগুলো এখন মূখ্য ফ্যাক্টরের ভূমিকা পালন করছে। পুর্বের দুনিয়ায় যা ছিল কল্পণাতীত। শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর ইচ্ছাই যেখানে শেষ কথা ছিল সেখানে আঞ্চলিক উপ আঞ্চলিক কানেক্টিভিটির ধারণা দুনিয়ার জটিল রসায়নে কিঞ্চিৎ বেশিই ধাক্কা দিয়েছে। দর কষাকষি বেড়েছে বিশ্ব বাণিজ্যে। তবে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো থেকে গরিব রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থ এখনো বড় অংশ বঞ্চিত থাকলেও যতটুকু সুবিধা আদায় করা সম্ভব হচ্ছে ঠিক ততটুকুর রস হাড়িতে দুর্বল রাষ্ট্রগুলো সংরক্ষণ করতে পারছে কি না সেটাই এখন দীর্ঘ বিতর্ক আর আলোচনার বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। তবে বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর পাশাপাশি অংশীজনমূলক আঞ্চলিক কিছু পরাশক্তির কারণে ছোট রাষ্ট্রগুলো এখনো সে অর্থে প্রভাব বিস্তার করতে পারছে না। এর কারণ হিসেবে যদি আমরা আমাদের দক্ষিণ এশিয়ার দেশ গুলোর দিকেই তাকাই তাহলে দেখা যাচ্ছে এখানকার মোট ৮ টি দেশের মধ্যে টেকসই রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রয়েছে মাত্র একটি দেশে। সেই দেশটিই (ভারত) আবার আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে প্রতিবেশি বাকী ৬টি (পাকিস্তান ছাড়া) নিজেদের রাজনৈতিক এবং বাণিজ্যিক নীতির শক্ত ক্ষেত্র তৈরিতে জোরালো ভূমিকা রাখছে। বাকী দেশগুলো ভারতের সাথে অংশীদারত্বের বড় একটি অংশ অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে। এর পেছনে বড় দুটি কারণ হচ্ছে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে পরস্পরের প্রতি অনাস্থা এবং রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের অংশ হিসেবে শুধুমাত্র বিদেশী ঋণ নির্ভরতাকে প্রাধান্য দেয়া। এর সুযোগে ঋণ দাতা আঞ্চলিক পরাশক্তি গুলো ছোট কিন্তু কানেক্টিভিটির ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালনকারী দেশগুলোর মর্যাদা এককভাবে কুক্ষিগত করে রেখেছে।

তিন

নতুন দুনিয়ায় প্রবেশের জন্য ছোট অথচ কানেক্টিভিটিতে খুবই গুরত্বপূর্ণ এমন একটি সৌভাগ্যবান রাষ্ট্র হিসেবে ইতোমধ্যে প্রাচ্যমুখী পৃথিবীর অর্থনীতির কেন্দ্র টোকিও, সাংহাই, হংকং, বেইজিং এবং নয়াদিল্লির নীতি নির্ধারক মহলে বাংলাদেশের নাম খুবই সাবধানতার সাথে যে বিশ্লেষণ চলছে সে বিষয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। এর সাথে চীনের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড বা দ্যা বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ পুরো দক্ষিণ, মধ্য এবং পূর্ব এশিয়াকে একক জালে আটকানোর একটি বৃহত্তর পরিকল্পনা হিসেবে বাংলাদেশের সামনে অপার সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে। ফলে কানেক্টিভিটির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের গুরত্ব যখন এশিয়ার তিন পরাশক্তি চীন, জাপান এবং ভারতের কাছে অনেকটা মধ্যপ্রাচ্যের সুয়েজ খালের মত হয়ে দাড়িয়েছে তখন এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে এবার বাংলাদেশকে এর সর্বোচ্চ সুফল সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর কাছ থেকে বের করে আনতে হবে। একই সাথে অর্জিত রস কিভাবে সংরক্ষণ করা যায় তার টেকসই উপায় বের করে আনা আমাদের গুরু দায়িত্ব (ফার্স্ট ট্র্যাক্ট রেস্পন্সিবিলিট)। আর তা না হলে বিদেশী ঋণ নির্ভর অর্থনীতি বরাবরই আন্তর্জাতিক অর্থনীতির স্ট্যান্ডার্ডে চিররোগা হয়েই থাকবে। এই মহুর্তে বাংলাদেশ তার জ্বালানি খাত যেভাবে প্রায় পুরোটাই আমদানি নির্ভর করে ফেলেছে ( ৮৫ ভাগ। জ্বালানি মহাপরিকল্পনা ২০১৬) এখানে বিদেশী ঋণ এবং আমদানি করা কয়লায় বিদ্যুৎ কেন্দ্র, কাতার থেকে এলএনজি আমদানি, রাশিয়ার ঋণে পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ এসব একদিকে যেমন অর্থনৈতিক এবং পরিবেশের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে সেই সাথে পরিবর্তনশীল জ্বালানির দুনিয়ায় অনেকটা উপহাস্য হয়ে দেখা দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা যেখানে সস্তা ক্লিন এনার্জির কথা বলছেন সেখানে আমরা হাঁটছি সম্পূর্ণ উল্টো পথে। যাক এরপরও কানেক্টিভিটি যেহেতু আমাদের সামনে অবারিত দুনিয়ার দরজা খুলে দিয়েছে ফলে মধ্য এশিয়া থেকে পাইপলাইনে গ্যাস আমদানির জন্য তাপি বা তুর্কমিনিস্তান থেকে আফগানিস্তান-পাকিস্তান হয়ে ভারত পর্যন্ত অথবা ইপি ইরান-পাকিস্তান-ভারতে আসা গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইনে বাংলাদেশের যুক্ত হওয়ার জন্য জোর চেষ্টা চালানো উচিৎ। তাপি প্রকল্পের কাজ এরই মধ্যে অনেকটা এগিয়ে গেছে। দিনশেষে আমরা দাবি করছি যে আমাদের আমাদের নিজস্ব জ্বালানি মূলত গ্যাস প্রায় নিঃশ্বেষ হয়ে গেছে। এর সাথে যুক্ত অন্য দেশগুলোর সে ধরনের অজুহাত নেই ফলে মাথাব্যথাও কম।

আশরাফুজ্জামান মণ্ডল

গবেষণা ফেলো, এমআই ফোর