বাংলার ঘরে ঘরে আজ উৎসব, আজ বাঙালির নববর্ষ

ই-বার্তা।।   বাঙালির সবচেয়ে বড় অসাম্প্রদায়িক উৎসব পহেলা বৈশাখ আজ। হাজারো প্রাণের মেলবন্ধনে পালিত হচ্ছে পহেলা বৈশাখের এই আয়োজন। সবার ঘরে ঘরে থাকবে বাঙালিয়ানার সব আয়োজন। সব ধর্ম-বর্ণের মানুষ মিলবে এক মোহনায়। গাইবে অসাম্প্রদায়িক চেতনার গান।

নতুন শুরুর প্রত্যয়ে সবাই গেয়ে উঠবে, ‘যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে-যাওয়া গীতি,/ অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক/ মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,/ অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।’

বাঙালির জীবনে আজ এক নতুন দিন, নতুন বারতা। আজকের সূর্যোদয়ের মধ্য দিয়ে সূচনা হলো বাংলা ১৪২৬ সালের। এলো পহেলা বৈশাখ। বাংলার ঘরে ঘরে আজ উৎসব।

সব জনপদ, লোকালয়, সমতলে, পাহাড়ে বর্ণিল রঙে রাঙাবে বাংলা। প্রাণে প্রাণ মিলে মেতে উঠবে বৈশাখী উল্লাসে।

জাগো ফুলে ফলে নব তৃণদলে/তাপস, লোচন মেলো হে।/জাগো মানবের আশায় ভাষায়,/নাচের চরণ ফেলো হে।/জাগো ধনে ধানে, জাগো গানে গানে,/জাগো সংগ্রামে, জাগো সন্ধানে,/ আশ্বাসহারা উদাস পরানে/জাগাও উদার নৃত্য।

রবিঠাকুর এভাবেই আবাহন করেছেন বাংলা নতুন বর্ষকে। আজকের বৈশাখে উৎসবে থাকবে নানা রং। গ্রাম থেকে শহর, নগর থেকে বন্দর সব জায়গায় আজ দোলা দেবে বৈশাখ।

মুড়ি মুড়কি, মণ্ডা মিঠাইয়ের সঙ্গে নাচে-গানে, ঢাকে-ঢোলে, শোভাযাত্রায় পুরো জাতি বরণ করবে নতুন বছরকে।

বাংলা নববর্ষের উৎসবের কথা এক শিরোনামহীন কবিতায় জীবনের শেষশয্যায়ও লিখে গিয়েছিলেন কবি সব্যসাচী সৈয়দ শামসুল হক।

তিনি লিখেছেন-আর কিছু নয়/একটুখানি/ওতেই আছে সব/একটি বাঁশির সুরে/আমার বাংলার উৎসব/গ্রামের ঘরে ঢুলি যাচ্ছে/বের করছে ঢোল/ঢোলের বুকে বাড়ি পড়ছে/চক্ষু মেলে তোল/এই তো আমার দেশের বাড়ি/এই তো উৎসব।

আজ বৈশাখে যেসব জায়গায় এখনও হালখাতার ঐতিহ্য রয়েছে সেখানে খোলা হবে বছরের নতুন খাতা। চলবে মিষ্টিমুখ। আর নববর্ষের নাগরিক ঐতিহ্যের দান পান্তা-ইলিশ খাওয়ার উৎসবে মাতবেন অনেকে। আজ বাঙালির নববর্ষ।

সব গ্লানি মুছে নবোদ্যমে শুরু হবে পথচলা। বাঙালি স্বাগত জানাবে ১৪২৬ সালকে। শুভেচ্ছা জানাবে- ‘শুভ নববর্ষ’ বলে। প্রকৃতির শাশ্বত নিয়মেই পুরাতনের বিদায়ে ঘোষিত হয় নতুনের আগমন।

প্রাত্যহিকতার সব জীর্ণ ও পুরাতনকে ফেলে রেখে নবসূর্যের উত্তাপ নিয়ে ১৪২৬ আসুক প্রাণের আশীর্বাদ হয়ে, এমনটাই প্রত্যাশা সবার। আর সেই প্রত্যাশা করার জায়গাটা থেকেই বাংলা সন বাঙালির নিজস্ব ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক।

বাঙালির বর্ষবরণ মানেই ছায়ানটের প্রভাতী আয়োজন। আজ সামাজিক সব অনাচারের বিরুদ্ধে মানুষের মনে শুভবোধ জাগিয়ে তোলার মানস নিয়ে ১৪২৬ বঙ্গাব্দকে বরণ করবে ছায়ানট।

অনাচারের বিরুদ্ধে জাগ্রত হোক শুভবোধ- এ আহ্বান নিয়ে সাজানো হয়েছে রমনার বটমূলের প্রভাতী আয়োজন। যথারীতি ভোর সোয়া ৬টায় বছরের প্রথম সূর্যোদয়কে স্বাগত জানানো হবে রাগালাপ দিয়ে। প্রত্যুষে থাকছে প্রকৃতির স্নিগ্ধতা ও সৃষ্টির মাহাত্ম্য নিয়ে ভোরের সুরে বাঁধা গানের গুচ্ছ।

পরের ভাগে থাকছে অনাচারকে প্রতিহত করা এবং অশুভকে জয় করার জাগরণী সুরবাণী, গান-পাঠ-আবৃত্তিতে দেশ-মানুষ-মনুষ্যত্বকে ভালোবাসার প্রত্যয়। বর্ষবরণ ১৪২৬ সরাসরি সম্প্রচার করবে বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতার।

শিক্ষার্থী-প্রাক্তনী-শিক্ষক নিয়ে, ছোটবড় মিলিয়ে এবারের অনুষ্ঠানে সম্মেলক গান পরিবেশন করবেন শ’খানেক শিল্পী। অনুষ্ঠানে থাকছে ১৩টি একক ও ১৩টি সম্মেলক গান এবং ২টি আবৃত্তি।

ছায়ানটের আহ্বান অনুযায়ী রবীন্দ্র রচনা থেকে বেছে নেয়া হয়েছে দুটি আবৃত্তি। একই ধারায় গানগুলো নির্বাচন করা হয়েছে কাজী নজরুল ইসলাম, অতুলপ্রসাদ সেন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেন, লালন শাহ, মুকুন্দ দাস, অজয় ভট্টাচার্য, শাহ আবদুল করিম, কুটি মনসুর, সলিল চৌধুরী ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনা থেকে।

জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সমাপ্তি টানার আগে ছায়ানট সভাপতি শুভবোধ জাগরণের আহ্বান জানাবেন তার কথনে। ইউনেস্কো মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ঘোষনা দিয়েছে।

বৈশাখের আয়োজনে মঙ্গল শোভাযাত্রা এক নতুন মাত্রা যোগ করে। সকাল ৯টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে বের হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। এর এবারের প্রতিপাদ্য- মস্তক তুলিতে দাও অনন্ত আকাশে।

যার মধ্য দিয়ে অস্থির সময়ে প্রেরণার ডাক দেবেন চারুকলার শিক্ষার্থীরা। এছাড়া বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, শিশু একাডেমি, বেঙ্গল ফাউন্ডেশন, জাতীয় প্রেস ক্লাব, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, কেন্দ্রীয় কচিকাঁচার মেলা, বেণুকা ললিতকলা কেন্দ্রসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে।

রাজধানীর পাঁচতারকা হোটেল সোনারগাঁও, র‌্যাডিসন, ওয়েস্টিন, ঢাকা রিজেন্সি, খাজানাসহ হোটেল-রেস্টুরেন্টগুলোর উদ্যোগেও উদযাপিত হবে নতুন বছরের উৎসব। পহেলা বৈশাখ উদযাপন করবে ঢাকা ক্লাব, গুলশান ক্লাব, উত্তরা ক্লাবও।