বেলা শেষে


ই-বার্তা প্রকাশিত: ২রা জুন ২০১৭, শুক্রবার  | দুপুর ১২:৫২ গদ্য

মুমতাহিনা মেহ্জাবিন

যার সাথে আমার বিয়ে হয়েছিল, সংখ্যাগত দিক দিয়ে আমি তার ১ম স্ত্রী তো নই-ই, ২য়ও ছিলাম না ,আমার অবস্থান ছিলো তারও পরে। মা বলেছিল, "তোর তো আর সতীনের ঘর করতে হবে না, আর তাছাড়া পুরুষ মানুষের আবার কিসের বয়স! সেদিন এসব কথা শুনে আমার প্রচন্ড অভিমান হলেও আজ ত্রিশের কোঠায় দাড়ানো আমি বুঝতে পারি যে, মা তখন কথাগুলো বলে আমাকে নয়, বরং নিজেকেই স্বান্তনা দিয়েছিল।

আমি তখন সবে ২১বছরের তরুণী। বাবা হুট করে একরাতে মারা গেলেন ছিনতাইকারীদের ছুরির আঘাতে। আমাদের চার বোনকে নিয়ে মা যেন তখন অথৈ সাগরে পড়লেন। সংসারে বাবা-ই ছিলো প্রধান উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। আর আমি পড়াশোনার পাশাপাশি কয়েকটা টিউশনি করতাম। বাবা মারা যাওয়ার পর আমি পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে চাকরি খুঁজতে লাগলাম, আর টিউশনিও চালিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু কোথাও কোনো ব্যবস্থা হচ্ছিল না। প্রায় সবাই ইঙ্গিতে বলেছিল আমি যদি তাদের সাথে একরাত কাটাই তাহলে চাকরি মিলতে পারে আমার। এই কুৎসিত প্রস্তাবে রাজি হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিলো না

এভাবেই কাটছিলো আমাদের দিন। বেশ কয়েকমাসের বাড়িভাড়াও বাকি পড়ে গিয়েছিল।
এরইমধ্য একদিন আমার এক ছাত্রীর চাচা টিউশনিতে থাকা অবস্থায় এসে আমাকে বলেছিল,
---কুসুম, আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই। আপনি রাজি থাকলে বাসায় প্রস্তাব পাঠাবো। এই কথাগুলো শুনে আমি কিছু বলার আগেই উনার মা চিৎকার করে বলেছিল, ---আমার পোলা হইয়াও এমুন বেয়াক্কেল হইলি কেমনে তুই! এই মেয়ের বাপ নাই, ভাই নাই ; আছে শুধু বুড়ি মা আর ৩টা বোইন। বিয়ার পর সবগুলি তোর ঘাড়ে চাপবো, বুঝছোস? এত পড়ালেহা করাইয়া তোরে ডাক্তার বানাইলাম কি এসব দেখতে? আশেপাশে তাকাইয়া দেখ কত সুন্দর সুন্দর মাইয়ার বাপেরা তোরে মাইয়ার জামাই বানাইতে আগ্রহী। এসব শুনে ছাত্রীর চাচা চুপ করে থেকেছিল। আর আমি ঘটনার আকস্মিকতায় বোবা হয়ে গিয়েছিলাম। এরপর আর ওই টিউশনিতে যাই নি কখনো। পরে একদিন জেনেছিলাম বেশ বড়লোকের একমাত্র সুন্দরী কন্যার সাথে ছাত্রীর চাচার বিয়ে হয়ে গেছে।

নিজে পড়াশোনা ছেড়ে দিলেও ছোট বোনদের পড়াশোনা বন্ধ করিনি। কিন্তু অভাব চারপাশ থেকে এমন ভাবে চেপে ধরেছিল যে ওদের জন্য ঠিকমতো তিন বেলা খাবার জোগানোই কষ্টকর হয়ে পড়েছিল। এমনই সময়ে চিলেকোঠায় ভাড়া থাকা মঈন ভাই এসে আমার মা-কে বলেছিলেন,
--খালাম্মা আমার তো কেউই নেই। আপনাদের আপত্তি না থাকলে কুসুমকে আমি বিয়ে করতে চাই। আমার ছোটখাট চাকরির বেতনে আশা করি সবাই মোটামুটি ভালোভাবেই থাকতে পারব।"
দরজার আড়ালে দাড়িয়ে আমি শুনেছিলাম এসব।
মঈন ভাইর প্রস্তাবের উত্তরে মা বলেছিল,
--"কুসুমের বিয়ে ঠিক করে ফেলেছি আমি।"
মায়ের কথা শুনে আমি বেশ চমকে উঠেছিলাম। আমি জানতামই না এসব। মঈন ভাই বিস্ময় চেপে রেখে বলেছিলেন,
---"ওহ, ছেলেটিকে কি আমি চিনি খালাম্মা?"
উত্তরে মা যা বলেছিল, এতদিন কেটে যাওয়ার পরেও সেসব আমার কানে বাজে।
মা বলেছিল,
-- হ্যা, চেনো। কুসুমের হবু বর আমাদের বাড়িওয়ালা।
আমি অবাক হয়ে শুনেছিলাম সব।
সেদিন রাতে আমি কেঁদে কেঁদে মা-কে বলেছিলাম,
--"বিয়ে ঠিক করার আগে কি আমাকে একবারও বলা যেত না? ওই লোকটার আগের ২বউই পালিয়ে গেছে, আর আমি তো চাচা বলে ডাকি উনাকে এরপরও কিভাবে বিয়ে করব বলো?"
মা বলেছিল, --"উনি তো তোর আপন চাচা না। আর তোকে তো সতীনের ঘরও করতে হবে না। বয়সটা একটু বেশি এই যা। পুরুষ মানুষের আবার কিসের বয়স? কয়েক মাসের যে বাসাভাড়া বাকি আছে সে খবর আছে তোর? টিউশনির সামান্য টাকায় সংসার চলে না এসব বুঝিস? তোর বোনদের কি বিয়ে দিবি না নাকি? এখন তো যৌতুক ছাড়া বিয়েও করবেনা কেউ। এসবের সমাধান আছে তোর কাছে? এই বিয়েটা হলে উনি বলেছেন আমাদের সারাজীবনের জন্য বিনাভাড়ায় থাকতে দিবে। এছাড়া তোর বোনদের ভালো ঘরে বিয়ে দিবে নিজে দাড়িয়ে থেকে। সেদিন মায়ের এসব কথা শুনে আমার মনে হয়েছিল যে, এই মহিলা খুবই স্বার্থপর।
কিন্তু আজ বাস্তবতার আঘাতে পরিণত আমি বুঝতে পারি যে, আমার মা স্বার্থপর নয়, বরং প্রচন্ড বাস্তববাদী মহিলা ছিলেন।

বিয়েটা হয়ে গিয়েছিল। বাসর রাতে আমি বুঝে গিয়েছিলাম অন্ধকারে কোনো কোনো পুরুষ পশু হয়ে যায়। তাদের কাছে পুরুষত্ব মানে হলো নিজের বউকে আঁচরে কামড়ে রক্তাক্ত করা। বিয়ের পরদিনই মঈন ভাই চলে গিয়েছিল বাসা ছেড়ে। আমার স্বামী উনার দেওয়া কথা রেখেছিলেন। আমাদের সংসারের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়েছিলেন।

বিয়ের কয়েকদিনের মধ্যেই বুঝতে পেরেছিলাম যে, আমার স্বামীর আগের ২বউ কেন পালিয়েছে। উনি শারীরিকভাবে দূর্বল প্রকৃতির ছিলেন। আর নিজের অক্ষমতা ঢাকার জন্যই প্রায় প্রতিদিন উত্তেজনাবর্ধক ঔষুধ খেয়ে মিলিত হতেন। বিয়ের কয়েকবছর কেটে যাওয়ার পরও আমার কোল আলো করে কারো আসার লক্ষণ দেখা দেয় নি। একপ্রকার জোরাজুরি করেই একদিন ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম উনাকে। পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষ করে ডাক্তার জানিয়েছিল সমস্যাটা আমার স্বামীর। উত্তেজনা বর্ধক ঔষুধ খাওয়ার ফলে উনার বাবা হওয়ার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে।

থমথমে মুখে বাসায় ফিরেছিলাম। সারাদিন উনি চুপচাপ শুয়ে ছিলেন। আমার মুখ দেখে মা কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিল হয়তো, মায়ের কান্না দেখেও না দেখার ভান করেছিলাম। আমি
তখন ভাবতাম আমার অবস্থার জন্য সম্পূর্ণ দায়ী আমার মা।
এর কিছুদিন পর মা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল।
অসুস্থ থাকা অবস্থায় মা একদিন আমাকে ডেকে নিয়ে বলেছিলেন,
--তোর খুব রাগ আমার উপর তাই না রে? একদিন বুঝবি আমি কেন এমন করেছি..
আমি কিছু না বলে চুপ করে ছিলাম। সেদিন রাতে মা মারা গিয়েছিলেন। ততদিনে আমার দুই বোনের বিয়ে হয়ে গিয়েছিল।

এরপর একদিন আমার স্বামীও শয্যাশায়ী হয়েছিলেন। যেদিন উনি জানতে পেরেছিলেন যে উনার কখনো বাবা ডাক শোনা হবে না, সেদিন থেকেই একটু একটু করে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। আশেপাশের কয়েকজন চুপিচুপি বলেছিলেন যে অন্যের সন্তান নিজের গর্ভে ধারন করে তারপর উনার সন্তান বলে চালিয়ে দিতে। এমন নাকি অনেক মেয়েই করে!
আমার মন সায় দেয় নি উনাকে ঠকাতে।

আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, উনি যখন সুস্থ ছিলেন তখন একদিনের জন্যও আমার উনার প্রতি মায়া হয় নি। বরং রাগ হতো প্রচুর। যদিও উনার প্রতি দায়িত্ব কর্তব্য ঠিকভাবেই পালন করার চেষ্টা করতাম, কিন্তু মনের মধ্যে রাগ পুষে রাখতাম। অসুস্থ উনার সেবাযত্ন করতে গিয়ে কখন যে মায়ায় পরে গিয়েছিলাম সেটা নিজের কাছেও অজানা। নিজ হাতে খাইয়ে দিতাম, গোসল করাতাম। যাবতীয় সব কাজও আমিই করতাম। এই অসুস্থ অবস্থায়ই আমার ছোট বোনের বিয়ে দিয়েছিলেন। মাঝে মাঝেই উনি আমার হাত ধরে কাঁদতেন আর বলতেন উনার উপর রাগ পুষে না রাখতে। আড়ালে আমিও কাঁদতাম, তবে সেটা উনার কষ্টে।

মানুষের মন বড় বিচিত্র। কার যে কখন, কাকে ভালো লেগে যায় সেটা আগে থেকে কেউই বুঝতে পারে না। একদিন ভোরে উনিও চলে গেলেন নানারকম অসুখে জর্জরিত নিজের শরীরটা রেখে। সেদিন সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা খেয়েছিলাম। কারন বাবা মারা যাওয়ার পর মাথার উপর
মা ছিলো, মা মারা যাওয়ার পর আমার স্বামী ছিলো অভিভাবক হিসেবে। কিন্তু এখন আর কেউ নেই। বোনরা নিজেদের সংসার নিয়ে ব্যস্ত। তখন আমার বয়স ছিলো ২৮। শুধুমাত্র আমার শরীরটার লোভে প্রায় প্রতি রাতেই কেউ না কেউ দরজায় টোকা দিত। নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছিলাম সব প্রলোভন থেকে। অচেতন মনে হয়তো কোনো একজনের জন্য অপেক্ষাও করছিলাম....!

এরপর কেটে গেলো প্রায় দুই বছর.. হঠাৎ একদিন ব্যস্ত রাস্তায় দেখা পেলাম আকাঙ্ক্ষিত পুরুষটির। সামনের কয়েকটা চুলে পাক ধরা মঈন ভাই এসে দাড়ালো আমার সামনে।
উনি বিয়ে করেন নি এখনো। তবে কি তিনিও আমার অপেক্ষায় ছিলেন! উনি এখন আমার সামনে দাড়িয়ে। কি নাকি বলার আছে উনার.. হঠাৎ নিরবতা ভেঙে বললেন,--"চলো না কুসুম এখান থেকেই তুমি আর আমি শুরু করি জীবনটা নতুনভাবে। আমাদের তো এখন আর পিছুটান নেই..
আমি অশ্রুসজল চোখে ভাবছি,
বেলা শেষে কেন এতো আলো.......!

সর্বশেষ সংবাদ

গদ্য এর আরও সংবাদ