গন্ধ


ই-বার্তা প্রকাশিত: ২২শে আগস্ট ২০১৭, মঙ্গলবার  | বিকাল ০৪:৪১ প্রতিক্রিয়া

শাফায়েতুল ইসলাম ।। বাসার কলিং বেল বেজেই যাচ্ছে, দরজা খোলার নাম গন্ধ নেই, মুকুল প্রচণ্ড বিরক্তের সাথে একটু পর পর বেল বাজিয়ে যাচ্ছে, কি অদ্ভুত ব্যাপার, দরজায় তালা দেওয়া নেই, তার ধারণা ভেতরে কেউ আছে, মুকুল বুঝতে পারছে না- দরজা খুলছে না কেন। সে দীর্ঘক্ষণ দাড়িয়ে থেকে ক্লান্ত, কারো কোন সাড়াশব্দ নেই, একরাশ তিক্ততা নিয়ে বাসায় চলে এলো।
এসেই হাত পা ছড়িয়ে বিছানায় শুয়ে পরল, শোয়া অবস্থায় চিৎকার দিতে দিতে মাকে বলল ভাত দেওয়ার জন্য, খুব খুদা লাগছে। মুকুলের আম্মা খুব মন দিয়ে টিভি দেখছেন, এই সময়ের মহিলারা সিরিয়াল ছাড়া কিচ্ছু বুঝে না, কি মজা পায় কে জানে, তিনশ চারশো পর্বের সিরিজ, কি ভয়ংকর ব্যাপার। যাই হোক গোসল শেষ করে ভাত খেতে বসল। আজ আলু বর্তা বেগুন ভাঁজি সহ কয়েক প্রকারের আয়োজন আছে, খাওয়ার সময় তার মা পাশে বসে থাকেন, খুব মন দিয়ে ছেলের খাওয়া দেখেন। মায়ের এই অভ্যাস অনেক আগের, মুকুল যেদিন নিজ হাতে খেতে শিখেছে ঠিক তখন থেকে রোজ পাশে বসে থাকেন। রোজ বললে ভুল হবে, অধিকাংশ সময়ই এমন করেন।


মুকুল খাওয়া দাওয়া শেষ করে বিছানায় পিঠ এলিয়ে দেয়, সে সময় বিছানাটা তার কাছে স্বর্গ মনে হয়।প্রতিদিনের এতো ব্যস্ততা, এতো ক্লান্তি তার আর ভাল লাগে না, মাঝে মাঝে নিজেকে খুব যন্ত্রের মত মনে হয়। প্রত্যেকবার শুতে গিয়ে মনে মনে বলে, এই মুহূর্তে যদি কেউ এক কোটি টাকার প্রস্তাব দেয়, তাহলেও সারা শব্দ দেওয়া যাবে না, তার সব কিছুর ঊর্ধ্বে এখন ঘুম প্রয়োজন, সমস্ত কিছু তলিয়ে যাবার মত করে গভীর ঘুম।

চোখ খুলে রাখতে পারছে না, খানিকটা ঘুমের ঘোরে চলে যেতেই মোবাইলটা বেজে উঠলো। ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে দেখে সুরভী কল দিয়েছে, মেয়েটা বিচিত্র ধরণের। যতক্ষণ পর্যন্ত কল না ধরা হবে ততক্ষণ পর্যন্ত কল দিয়েই যাবে, অসীম ধৈর্য নিয়ে কিছু মানুষ জন্মায়, তাদের একটা লিস্ট করলে প্রথম দশ জনের মধ্যে সুরভী একজন হবে।

হ্যালো সুরভী, কেমন আছো ?

মুকুল ভাই, আপনি আমাদের বাসায় গিয়েছিলেন, এবং সাতাশ মিনিট ধরে দরজার ও প্রান্তে দাড়িয়ে ছিলেন, আপনার অপেক্ষায় আমি রীতিমত মুগ্ধ।

তুমি তাহলে আমাকে দেখেছ, কেন এমন করলে ? তুমি কি জানো, খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজে তোমাদের বাসায় গিয়েছিলাম, কাজটা ভাল করো নি, তোমার উপর ভীষণ রাগ হচ্ছে।

আপনি বাবার কাছে এসেছিলেন সে সময় বাবা তো বাসায় ছিল না, তাছাড়া আমি বাসায় একা ছিলাম, যদি বলতাম বাবা বাসায় নেই তাহলে আপনি এক মিনিটের জন্যও দাঁড়াতেন না, কিছুক্ষণ পর পর আপনার বিরক্তির ছাপ ভেসে উঠা চেহারাটা দেখতে খুব ভাল লাগছিল। যাই হোক- আমি আপনার বাসার নিচে দাড়িয়ে আছি, দ্রুত নিচে নেমে আসুন।

তুমি আমার বাসার নিচে কি করো ?

আপনি নাকি বাবার কাছে কিছু টাকা পান, সেই পাওনা টাকা দিতে এসেছি।

আচ্ছা, পরে নিলে হয় না, আমি নিজেই সময় করে গিয়ে নিয়ে আসব।

না, আজকেই নিন, তাছাড়া আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে, খুব গোপন কথা।

একটা গোপন কথা আছে বলেই সুরভি হেসে দিল, হাসির শব্দটা এমন যেন কান দিয়ে মাথায় গিয়ে স্পর্শ করছে।

মুকুল না পারতে বিছানা ছেড়ে উঠে বসে, অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকে, যাবে কি যাবে না। তাছাড়া না যেয়ে উপায় নেই, মেয়েটা জাঁদরেল ধরনের। সে সুরভীকে প্রথম দেখেছিল এক চায়ের দোকানে, বাবা মেয়ে এক সাথে বসে চা খাচ্ছে, কি অদ্ভুত দৃশ্য। যদিও বা এই বঙ্গ প্রদেশে এমন দৃশ্য ভাবাই যায় না, সে দিন তাঁরা দুজন কোন একটা বিষয়ে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছিল, সুরভীর হাসি এতো সুন্দর যে মুকুল দীর্ঘক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল। সুরভীর বাবার সাথে মুকুলের খুব ভাল সম্পর্ক, ব্যবসায়িক কাজে অথবা সময়ে অসময়ে এক সাথে আড্ডা হয়। যদিও বয়সের ব্যবধান বিশাল, সুরভীর বাবা মুকুলকে খুব স্নেহ করেন, ব্যবসাটা মূলত এক্সপোর্ট ইমপোর্টের।
সুরভীর বাবা মুখলেছ উদ্দিন খুব বিচিত্র প্রকৃতির, মুকুলের সাথে তার পরিচয়টাও খুব অদ্ভুত, একদিন সন্ধ্যায় খুব বৃষ্টি হচ্ছিল, তুমুল বৃষ্টি, মুকুল দ্রুত এক চায়ের দোকানে ঢুকে পরে, সাদা ধবধবে লুঙ্গি আর একটা পাঞ্জাবি পরা পঞ্চাশ ঊর্ধ্ব বয়সী লোক খুব আরাম করে চায়ের সাথে বিস্কিট চুবিয়ে খাচ্ছেন। খাওয়ার দৃশ্যটা খুব সুন্দর ছিল, বাতাসের সাথে বৃষ্টির ঝাঁপটার পানি, মাঝে মধ্যে মুখলেছ উদ্দিন কে ভিজিয়ে দিচ্ছে, সে দিকে তার খেয়াল নেই, এক মনে চা বিস্কিট খেয়ে যাচ্ছে।

মুকুল একটা সিগারেট ধরিয়ে লোকটির সামনে বসল, মুখলেছ সাহেব খানিকটা কুঁজো হয়ে খুব আগ্রহ নিয়ে বললেন, বাবা তুমি তো পুরাই ভিজে গেছ।

বাহিরে যেই বৃষ্টি, হুট করে নেমে পরেছে, কোথাও দাঁড়ানোর জায়গা খুঁজে পায়নি।

মুখলেছ উদ্দিন সেদিন মুকুলের সাথে অনেকক্ষণ আড্ডা দেয়, নানান কথার ফাঁকে খুব আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করে, আচ্ছা বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে কখন সিগারেট খেয়েছ ?

মুকুল খানিকটা অবাক হয়ে তাকায়, সেদিন সে কিছুই বলে নি। তারপর একটা চাপা আগ্রহ গোপন করে মুকুল জিজ্ঞেস করলো, আপনি তো চাচা সিগারেট খান না, তাই না ?

মুখলেছ উদ্দিন একটা মৃদু হাসি দিয়ে কিছুই বলেন নি।

সেদিনের সন্ধ্যায় মুকুল ঠিকই বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে সিগারেট খায়, বাসায় ফিরে কাক ভেজা হয়ে, তারপর টানা কয়েক দিন জ্বর ঠাণ্ডা লাগিয়ে অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়েন, সুস্থ হওয়ার অনেক দিন পর আবার সেই টঙ্গের দোকানে মুখলেছ উদ্দিনের সাথে দেখা, সেদিন তেমন কোন কথা হয় নি, মুকুল উঠে যাবারে সময় তাকে বাসার ঠিকানা দিয়ে যায়। একদিন সময় করে বাসায় যাবার জন্য খুব অনুরোধ করে।

এই ভাবেই ধীরে ধীরে মুখলেছ উদ্দিনের সাথে সম্পর্ক সুমধুর হতে থাকে। একদিন কথার প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে অনেক কথাই বলে ফেললেন, বুঝলা মুকুল- মা মরা মেয়েটাকে খুব সখ করে বিয়ে দিয়েছিলাম, ছেলে রাজপুত্রের মত ছিল, খুব অমায়িক। যখনই আমার সাথে দেখা করতে আসতো পায়ে ধরে সালাম করতো। মেয়েটার কপালে এত সুখ সইলো না, তিন মাসের মাথায় ছেলেটা মারা যায়, তাও আবার রোড এক্সিডেন্টে। কি যে ভয়াবহ দিন ছিল, ছেলেটাকে বাঁচানোর জন্য সবাই মিলে কতো আপ্রাণ চেষ্টা করলাম। মেয়েটা অবশ্য স্বামীর ঘরেই আজীবন থাকতে চেয়েছিল, ছেলের পরিবার রাখেনি। তাদের কথা হচ্ছে- সংসারে ছেলে নেই তো এই মেয়ে থাকবে কেন ? মেয়েটা প্রায়ই গভীর রাতে ব্যালকনিতে দাড়িয়ে কান্না করে, নিজে নিজেই কথা বলে, কার সাথে কথা বলে কে জানে। অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে বিয়ে দিতে চেয়েছি, তার একটাই কথা সে বিয়ে করবে না, আজীবন আমার সাথেই থেকে যাবে, মেয়েটার চেহারার দিকে তাকাতে পারি না, খুব দুঃখ হয়, বুঝলা, খুব দুঃখ হয়।
সুরভী আজ নীল রঙের শাড়ি পরেছে, দেখতে স্নিগ্ধ মায়াবতী লাগছে, প্রচণ্ড মায়া মায়া চেহারা, কিছুক্ষণ আগে গোসল করেছে নিশ্চয়, ভেজা চুল থেকে সৌরভ ছড়িয়ে পরছে, যদিও বা সুরভীর নামের সাথে সৌরভের একটা অদ্ভুত মিল রয়েছে, তাকে এই নাম কে দিয়েছে জিজ্ঞেস করা দরকার। মুকুল প্রায় সময় খেয়াল করেছে, সুরভীর গা থেকে এক প্রকার গন্ধ আসে, নেশা ধরিয়ে দেওয়ার মত গন্ধ, মাঝে মধ্যে মাতাল করে দেয়, গন্ধটা মুকুলের ভাল লাগে, ভীষণ ভাল লাগে।

মুকুল ভাই, আপনার হাতে সময় আছে ?

কেন বলতো ?

আপনাকে নিয়ে কফি শপে যাব, আমি আপনি মিলে কফি খাব।

এইসব কফি খাওয়ার প্রসঙ্গ ছেড়ে রফিক সরাসরি টাকা খুঁজে বসলো, আমার টাকা কোথায় ?

বাবা তো আমাকে টাকা দেয় নি, তাছাড়া আমি টাকার কথা না বললে আপনি কখনই নিচে নামতেন না, তাই ইচ্ছে করে মিথ্যা কথা বলেছি।

সুরভীকে ধমক দিতে গিয়ে মুকুল চুপ হয় যায়, প্রচণ্ড রাগ চেপে ধরে।
আমার উপর কি আপনার রাগ হচ্ছে ?

না, মোটেও না, তোমাকে খুব আদর করতে ইচ্ছে করছে।

বুঝতে পারছি, আপনি আলতো করে আমার হাত ধরেন, রাগ কমে যাবে।

হাত ধরার বিষয়ে মুকুল অবাক হয় নি, এই রকম অনুরোধ এর আগেও অনেক পেয়েছে, কিন্তু মুকুল এমন ভাব করে যেন সে এই সব কথা শোনে নি। তার ধারণা, অপূর্ব সুন্দরি মেয়েদের তাচ্ছিল্য করতে হয়, এই তাচ্ছিল্য থেকে এক ধরণের অপমান বোধ জন্মায়, সেখান থেকে প্রতিশোধ, তারপর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে গভীর প্রেমে হাবুডুবু। খানিকটা নব্বই দশকের বাংলা ছবির কাহিনীর মত।

মুকুল আর সুরভী লিংঝি নামের একটা কফি শপে বসে আছে, লিংঝি নামের অর্থ কি ? সুরভীকে জিজ্ঞেস করা যেতে পারে, তার বিভিন্ন ভাষার উপর খুব ভাল দক্ষতা রয়েছে।

আচ্ছা মুকুল ভাই, আপনি আমাকে দেখতে পারে না কেন ?

কে বলল দেখতে পারি না ?

আমি বুঝতে পারি, খুব ভাল করেই বুঝতে পারি।

কি বুঝতে পারো ?

এই যে আমাকে প্রচণ্ড পরিমাণে তাচ্ছিল্য করেন, এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন।
মুকুল বোকা বোকা হাসিয়ে দেয়, বুঝা না বুঝার মাঝামাঝি অবস্থানে থেকে যে হাসিয়ে দিলে মানুষ দ্বিধা দন্ধে পরে যায়।

কি ব্যাপার ? হাসছেন কেন ? উত্তর দেন ?

আচ্ছা, সুরভী লিংঝি শব্দের অর্থ কি ? এইটা কোন দেশী শব্দ ?

জানি না, আপনার প্রতি ভীষণ রাগ হচ্ছে।

আচ্ছা, বাদ দেও তো ওসব কথা, তোমার দিন কাল কেমন যাচ্ছে ?

জানেন, প্রায় রাতেই আমি আমার স্বামীকে দেখতে পাই, প্রথম অবস্থায় স্বপ্নে দেখছি বলে মনে হত, মাঝে মধ্যে হেলোসিনেশন মনে হতো। আমার বিছানায় এসে বসতো, আমি ও খুব আহ্লাদী হয়ে গায়ে গা লাগিয়ে বসে পরতাম। তারপর সে মাথায় হাত বুলিয়ে দিত, নানা বিষয়ে গল্প করতো। একদিন কথার প্রসঙ্গে বলল, আপনি নাকি লোকটা বেশী সুবিধার না, আমি যেন আপনার সাথে মেলামেশা না করি, ব্যাপারটা সে পছন্দ করে না। আপনি নাকি টাউট বাটপার, এই কথা বলেই সুরভী খিলখিল করে হেসে দিল।

মুকুল অবাক দৃষ্টি নিয়ে সুরভীর দিকে তাকিয়ে থাকে, তার ইচ্ছে করে তীব্র গাঢ় ভালোবাসা দিয়ে সুরভীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে, কাছে বসে তার শরীরের গন্ধ নিতে, নেশা লাগানো সেই গন্ধ, মাতাল করে দেওয়া মত গন্ধ। যে গন্ধ পৃথিবীর সমস্ত কিছুকে হার মানায়।

আচ্ছা সুরভী, তুমি কি জানো, আমি কেন দরজার ওপাশে সাতাশ মিনিট দাড়িয়ে ছিলাম ? আমি জানতাম তুমি দরজার ওপাশে ছিলে।

কিভাবে বুঝতে পারলেন ?

তোমার স্বামী কি কোন দিন বলেছে, তোমার গা থেকে এক প্রকারের সুগন্ধি সৌরভ ছড়ায় ?

হ্যাঁ বলে ছিল, এবং আরও অনেক কিছুই বলে ছিল।

এই কথাটা বলতে বলতেই সুরভীর গলার স্বর ভিজে উঠে, গাল বেঁয়ে বেঁয়ে লোনা জল গড়িয়ে পরে, সে জলের প্রতি ফুঁটায় মুকুলের বুক চিরে নদী বয়ে চলে। সে নদী বড্ড শান্ত, একটা গাঙচিল এসে সেই নদিতে প্রায় সময় ঠুকর দেয়, প্রতি ঠুকরে মুকুলের কল্প রাজ্যে একক অধিপতি বিষাদে পরিপূর্ণ ভালোবাসায় গ্রাস করে। সুরভীও চুপ করে থাকে, মুকুল ও চুপ করে থাকে, তাদের অসংখ্য বলা না বলা কথার ভেতর দিয়ে দুপুর গড়িয়ে বিকেল আসে, তারপর দীর্ঘ রাত নেমে এলে দুজন মিলে যোজন দূরে মৌনতাকে সঙ্গী করে বেঁচে রয়।

সর্বশেষ সংবাদ

প্রতিক্রিয়া এর আরও সংবাদ