মৃত্যুর পর মানব দেহের পরিনতি


ই-বার্তা প্রকাশিত: ৯ই অক্টোবর ২০১৭, সোমবার  | বিকাল ০৫:৪৩ অন্যান্য

ই- বার্তা।। জন্মালে মৃত্যুবরণ করতে হয় এটাই স্বাভাবিক। যারা মৃত্যুর পরের জীবনকে বিশ্বাস করেন তারা এটাও মানতে রাজি হবেন যে, মৃত্যু হচ্ছে জীবন ও পুনঃ জন্মনের মাঝা মাঝি একটি অধ্যায়। বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি যত এগিয়েছে, মৃত্যুর সংজ্ঞা হয়ে উঠেছে বিশাল থেকে বিশালতর। মৃত্যু পরবর্তী দেহের ভাঙনের বিষয় গুলো আমরা অনেকেই জানলেও সবার বোধয় তা যানা নেই।

মৃত্যুপ্রক্রিয়াটি ঐ মুহূর্তেই শুরু হয়ে যায়, যখন শরীর তার কার্যাবলী সচল রাখার জন্য পর্যাপ্ত অক্সিজেন পায় না। অক্সিজেন না পেয়ে মস্তিষ্কের কার্যক্রম থেমে যায়, তখন হরমোন নিঃসরণও বন্ধ থাকে, এজন্যই শরীরের সব ধরনের কাজ বন্ধ হয়।

তবে কয়েক মিনিট দেহের কিছু কাজ চলতে পারে। সেটা হয়ে থাকে এটিপি-এর দ্বারা। এটিপি (এডেনোসিন ট্রাই ফসফেট) হলো দেহের শক্তির একক। খাদ্য থেকে এই এটিপি তৈরি হয়। সংরক্ষিত এটিপি শেষ না হওয়া পর্যন্ত চলতে থাকে কিছু কাজ। এটিপি (এডেনোসিন ট্রাই ফসফেট) হলো দেহের শক্তির একক। খাদ্য থেকে এই এটিপি তৈরি হয়। সংরক্ষিত এটিপি শেষ না হওয়া পর্যন্ত চলতে থাকে কিছু কাজ।

পেশিগুলো জীর্ণ হয়ে পড়ে, স্ফিংটারগুলোও স্তিমিত হয়ে পড়ে। ১৫ থেকে ২৫ মিনিট পর, কৈশিকজালিকাগুলোয় যখন আর রক্ত পৌঁছায় না, দেহের রং তখন ফ্যাকাশে রূপ ধারণ করে। কারণ মৃত ব্যক্তির হৃৎক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, সারা দেহে আর রক্ত পৌঁছানো সম্ভব হয় না। অভিকর্ষের টানে দেহের সমস্ত রক্ত পৃষ্ঠীয় অংশে জমতে শুরু করে। মৃত ব্যক্তির মুখ উপরের দিকে করে শোয়ানো থাকে বিধায়, অভিকর্ষের টানে রক্ত পৃষ্ঠীয় অংশে জমা হয়। জমে জমে দেহের পেছনের অংশে ব্লাড পোলের মত তৈরি করে।

মানবদেহে বিভিন্ন কোষ আর টিস্যু থাকে। বিভিন্ন কোষের মৃত্যুর সময়কালও কিন্তু ভিন্ন হয়ে থাকে। তাই মৃত্যু নির্ভর করে কোষগুলোর অক্সিজেন ঘাটতি কখন ঘটছে সেটার উপর। শরীরের ভেতর পিউট্রেফিকেশন (Putrefication) এর দরুন গ্যাস তৈরি হয়, মৃতদেহ পানিতে ফেলা হলে এজন্যেই ভেসে উঠে। এই গ্যাসের কারণেই শরীর ফেঁপে উঠে। এক সপ্তাহ পর, ত্বকীয় কোষগুলো দৃঢ়তা হারিয়ে এতটাই চুপসে যায় যে, হাত দিয়ে একটু স্পর্শ করলেই ছিঁড়ে পড়ে যাবে।

আমাদের মস্তিষ্কে কিন্তু বেশ বড়সড় পরিমাণে অক্সিজেন প্রয়োজন হয়। না হয় মস্তিষ্ক সচল থাকে না। তাই মস্তিষ্ক নিজের জন্য সামান্য পরিমাণে অক্সিজেন জমা করে রাখতে পারে। তিন থেকে সাত মিনিটের মধ্যেই মস্তিষ্কের অক্সিজেন ফুরিয়ে যায়, তখনই কোষগুলোর মৃত্যু হতে শুরু করে। মৃত্যুর কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হয় রিজোর মরটিস। ল্যাকটিক এসিড আর মায়োসিন প্রোটিনের সহায়তায় এক জটিল রাসায়নিক ক্রিয়া সম্পাদিত হয়, যার ফলে শরীরের দৃঢ়তা ভেঙে পড়ে। সাধারণত এটি ২৪ ঘণ্টা স্থায়ী হয়।

এক সপ্তাহের ব্যবধানে, ত্বকে ফোস্কার মতো দেখা যায়, সামান্যতম স্পর্শেও ত্বকের টিস্যু চুপসে যেতে শুরু করে। এক মাসের মাঝে দেখা যায় চুল, নখ আর দাঁত দেহ থেকে আলাদা হয়ে আসতে।

ব্যাকটেরিয়া, জীবাণুর হাত থেকে রক্ষা করতেই আমাদের শরীরের অধিকাংশ অংশ এসিডিক হয়ে থাকে। মৃত্যুর পর যেহেতু এসিডিক অবস্থা হ্রাস পায়, তাই প্লাজমা মেমব্রেন ফেটে পড়তে শুরু করে, সাইটোসোল (সাইটোপ্লাজম) মুক্ত হয়ে কোষীয় অঙ্গাণুগুলোকে মুক্ত করে দেয়। অঙ্গাণুগুলো বেরিয়ে আসে মুক্ত শরীরে, এগুলো ক্যালসিয়াম তৈরি করে, ওটা পেশিকোষকে স্টান্ট করে দেয়, তাই পেশিগুলোকে সহজে নড়াচড়া করানো যায় না, মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত শরীর যেভাবে থাকে ঠিক সেভাবেই স্টান্ট হয়ে থেকে যায়।

পাকস্থলীর নিচে, ডিওডেনামের ভাঁজে মরিচের মতো মানবদেহের একটই অংশের নাম হলো ‘অগ্ন্যাশয়’। এই অংশে এত সংখ্যক ব্যাকটেরিয়া থাকে যে, মৃত্যুর পর এটি নিজেকেই নিজে নষ্ট করে ফেলে। আস্তে আস্তে ব্যাকটেরিয়াগুলো দেহের অন্যান্য অঙ্গেও ছড়িয়ে পড়ে। দেহের রং তখনই পাল্টাতে শুরু করে। সম্পূর্ণরূপে রং বদল প্রক্রিয়া বারো ঘণ্টা পর্যন্ত চলতে থাকে। ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা এই রং বদলের ক্রিয়া লক্ষ্য করেই মৃত্যুর সময় নির্ণয় করে থাকেন। পাকস্থলীর ব্যাকটেরিয়াগুলো চলে আসে ত্বকীয় কোষে, দেহ দ্রুত সবুজ রং ধারণ করতে শুরু করে, হিমোগ্লোবিন থেকেই এই সবুজ রং ধারণ করা।

সাইটোসোলের সাথে প্রোটিন আর এনজাইমও বের হয়ে আসে শরীরের মুক্ত অংশে। তারাই আশপাশের ভাঙার কাজ দ্রুত চালিয়ে নেয়। আর কোষের মাঝে লাইসোজোম তো থাকেই, যাকে বলা হয় ‘আত্মঘাতী থলিকা’। ফ্যাগোসাইটোসিসে সিদ্ধহস্ত এ বস্তু। ফ্যাগোসাইটোসিস হলো জীবাণু ধ্বংস করার একটি প্রক্রিয়া, এই লাইসোজোম জীবিত অবস্থায় আমাদেরকে জীবাণু থেকে সুরক্ষা দিয়ে আসছিলো এতদিন। মৃত্যুর পর সাইটোসোল মুক্ত হয়ে পড়াতে লাইসোজোমও বেরিয়ে আসে কোষের সুরক্ষিত অংশ থেকে, নিজেকে সহ সমস্ত সাইটোসোল সাবাড় করে ফেলে। এর নাম অটোফ্যাগোসাইটোসিস।

বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন, লাইসোজোম হলো কিছু এনজাইমের সমষ্টি, যা মুক্ত হলে সবকিছু ধ্বংস করতে শুরু করে দেয়। শুধুমাত্র ব্যাকটেরিয়া দ্বারা যদি মৃত্যুপরবর্তী পচনকার্য (পুট্রেফাইং) হতো, তাহলে বছরের পর বছর লেগে যেত একটা মৃতদেহ নিঃশেষ হতে। লাইসোজোমের কারণেই এই কাজটি খুব দ্রুত হয়ে থাকে।

তবে দেহের মাঝে কিছু অতি ক্ষুদ্র প্রাণী তখনও বেঁচে থাকে, যা দেহকে পচাতে আরম্ভ করে। অন্ত্রের মিথোজীবী ব্যাকটেরিয়া, যেগুলো জীবিত অবস্থায় খাদ্যসার শোষণে আমাদেরকে সাহায্য করে এসেছে। অন্ত্রে থাকে ১০০ ট্রিলিয়ন অবায়বীয় ব্যাকটেরিয়া। অবায়বীয় মানে হলো, যাদের বাঁচতে কোনো অক্সিজেন প্রয়োজন হয় না। তারাই অন্ত্রীয় বিশাল অংশকে দ্রুত ভক্ষণ করতে শুরু করে। অন্ত্রের অ্যামিনো এসিডকে পচিয়ে ব্যাকটেরিয়াগুলো দুর্গন্ধের সৃষ্টি করে। ব্যাকটেরিয়ার পচানোর কাজটাকে বলা হয় পুট্রেফাইং।

৫০ দিনের মাথায় শুরু হয় আরেকটি প্রক্রিয়া, এর নাম ‘বিউটাইরিক ফার্মেন্টেশন’। এটি প্রোটোজোয়া জাতীয় প্রাণীকে আকর্ষণ করে। কখনো কখনো ছত্রাককেও আকর্ষিত হতে দেখা যায়। তাদের ভক্ষণ পদ্ধতি বেশ দ্রুত, তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে ভক্ষণকার্য আরও বেড়ে যায়। আর বছরের শেষ মাথায় মৃতজীবী প্রাণী আর উদ্ভিদ তো আছেই। তারাও খেতে শুরু করে যা অবশিষ্ট থাকে। মৃত্যুর কিছুদিন পর থেকে এ সকল মিথোজীবী ব্যাকটেরিয়াগুলো তাদের পোষককে পঁচিয়ে ফেলার কাজ শুরু করে দেয় পরিপূর্ণরূপে।

কবির ভাষায় শেষ করছি, জন্মিলে মরিতে হয়ে এই বচন। যখন তুমি এসেছিলে ভবে, কেদেছিলে তুমি, হেসে ছিল সবে। এমন জীবন তুমি করিয় গঠন মরণ কালে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভুবন। মৃত্যু পরবর্তী একজন মানুষের শরীরটা পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যহীন বিষয়েই পরিণত হয়। মৃত্যুর পর মানুবদেহের এই ক্ষয়প্রক্রিয়া আমাদের বারে বারে শুধু মনে করিয়ে দেয়, এই জীবন, এই শরীর, সবই নশ্বর; আমরা কোনো অবিনশ্বর সত্তা নই।

সর্বশেষ সংবাদ

অন্যান্য এর আরও সংবাদ