ফেসবুক সমাচার “সুতরাং” - পুনম মায়মুনী


ই-বার্তা প্রকাশিত: ১৬ই অক্টোবর ২০১৭, সোমবার  | সন্ধ্যা ০৭:১২ গদ্য

ই-বার্তা ।। ভার্সিটি থেকে বাসায় ফিরে, হন্তদন্ত হয়ে লুবনা তার নিজের ঘরে ঢুকে কাঁধের ব্যাগটা টেবিলে ছুড়ে ফেলে। নাহ্ এর একটা বিহিত করতেই হবে আজ! এভাবে আর চলছে না। এবারের সেমিস্টারের রেজাল্টাও খারাপ হয়েছে। সামনে ফাইনাল পরীক্ষা। কিছুতেই পড়ায় মন বসাতে পারছেনা। এর একটাই কারন, ফয়সাল! ফেসবুক বন্ধু... না বন্ধু বললে কম হবে, ফেসবুক প্রেমিক। দুবছর আগে লুবনার সাথে ফয়সালের প্রথম চ্যাট, তারপর বন্ধুত্ব তারপর পৌছে গেছে হৃদয়তা সম্পর্কে।

কিন্তু আজও হয়নি দুজন দুজনকে দেখা আর মুখোমুখি কথা বলা। প্রোফাইলের ছবি দেখেই দুজনের মন এক মোহনায় এসে ঠেকেছে। কি দিন, কি রাত চলছেই বোতাম টিপাটিপি টুপ টুপ টুপ। আকাশের মিটিমিটি তারা, চাঁদ-জোছনা, নদী, পাখী, সাগর, পাহাড় নিয়ে কতো কবিতা-গান, সুরে-সুরে, ছন্দে-ছন্দে দুজনে আটলান্টিক মহাসাগরে ডুবে গেছে প্রেমের ডুব সাঁতারে, কখনো বা আবেগে কল্পনার জ্বালে হারিয়ে গেছে সিনেমার মতো হিমালয়ের পর্বতচূড়ায়।

অনার্স ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী লুবনা। রেজাল্টগুলো দুর্বল হওয়ায় মা-বাবার বকুনি আর যেন সইতে পারছেনা। ফয়সালকে একটিবার সামনাসামনি দেখার, কথা বলার জন্য মনটা ভীষন ব্যকুল হয়ে ছটফট করছে। কোন কিছুতেই মন বসাতে পারছেনা লুবনা। কাউকে কিছু বলতেও পারছেনা তার মনের অস্থিরতার কথা, এমনকি বান্ধবীদেরও না।
লুবনা নিশ্চিত ওরা শুনলে আমায় দোষারোপ করবে- না দেখে, না বুঝে কেউ আবার প্রেমে পরে বোকা!
পরে...পরে, পরে সেই বোঝে, ভালোবাসায় মাপকাঠি কিরে??
নিজেই বিড়বিড় করে বলতে থাকে। কতদিন ফয়সালকে দেখা করতে বলে ব্যর্থ হয়েছে সে। একবার দিনক্ষণ ঠিকও হয়েছিল, স্টার কাবাবে দুই ঘন্টা বসে থেকে অপেক্ষা করার পরও ফয়সালের কোন পাত্তা নেই তারপর রাতে ফেসবুকে, দুই হাতে কানে ধরা একটি ছেলের বড় ছবি পোষ্ট করে, নিচে লিখা ছিল, sorry sorry sorry. তারপর জানালো, বিশেষ একটি জরুরী কাজে আসতে পারিনি, তবে শীঘ্রই দেখা করবে, ব্যস! এই পর্যন্তই আর দেখা করার নাম নেই। ফয়সালের ঐ একই কথা, তোমার মাস্টার্সটা শেষ হোক, মাত্র তো কটা দিন! এভাবেই তো বেশ আছি লক্ষীটি!
- না, না মাস্টার্স শেষ মানে ৩/৪ বছরের ব্যবধান, অসম্ভব! প্লিজ আমায় আর প্রতিক্ষায় রেখোনা। তোমার এই “না শোনাটা” আমি আর মানবোইনা! নাছরবান্দা লুবনা। দেখা না করলে এখনই ব্লক। অনেক বুঝিয়েও নিরুপায় হয়ে ফয়সাল বেশ কিছুক্ষণ পর উত্তর দেয়, আমায় তুমি চিনতে পারবে তো? চিনবোনা মানে! তুমি যে আমার মনের চোখের সাথে, একাকার হয়ে মিশে আছ! চোখ বন্ধ করেও, ঠিক তোমায় খুঁজে নিতে পারবো!


বাধ্য হয়ে দুজনের আবার দেখা করার দিন ঠিক হয়। আর কোন কথা নয়! কাল শেষ বিকেলেই তাদের দুজনের দেখা হবে গুলশান পার্কে।
লুবনার কাছে সত্যিই আজকের সকালটা যেন অসাধারন লাগছে। সূর্যটাও তার আনন্দের শরীক হয়ে হেসে হেসে জ্বলছে, দুষ্ট হাওয়া এসে সারা গায়ে লুটোপুটি খেয়ে বার বার চুলগুলো এলোমেলো করে দিচ্ছে। কেমন একটা লজ্জা লজ্জা লাগছে লুবনার। কেন এমন লাগছে নিজেও বুঝতে পারছেনা, হয়তো প্রথম ফয়সালের মুখোমুখি হবে তাই! কখন বিকেল হবে, কখন বাজবে সেই ঘন্টা! আজকের দিনটা বড্ড বেশী ধীরে ধীরে এগুচ্ছে! আর যেন তর সইছেনা লুবনার।

অবশেষে অপেক্ষার পালা শেষ হয়ে গড়িয়ে এলো শেষ বিকেল। ফয়সাল লুবনার পছন্দের একটি সাদা পান্জাবী আর হাতে একগুচ্ছ রজনীগন্ধার তোরা নিয়ে, পার্কে তাদের চিহ্নিত যায়গায়, একটি গাছের ছায়ায় গিয়ে বসে, লুবনার অপেক্ষায়। লুবনাও ফয়সালের পছন্দের হালকা গোলাপি শাড়ী, হাতে ফয়সালেরই পছন্দের একটি গোলাপের তোড়া। পরিপাটি ২১/২২ বছরের স্মার্ট সুন্দরী তরুণী লুবনা, যথাসময় এসে পৌছে যায়। একটু সামনে এগুতেই ফয়সালের পিছনদিকটা নজরে পরে, একটি লোক বসে আছে, পাশে তাজা রজনীগন্ধা, হ্যা, ওটাই ফয়সাল! আমার পছন্দের ফুল! নিশ্চিত হয়ে এক পা দুপা করে এগিয়ে যায় লুবনা। বুকের ভিতর কেমন যেন একটা আতঙ্ক, ভয়, লজ্জা সব মিলিয়ে ভীষণ নার্ভাস লাগছে, এতদিন পর দুজনের সামনাসামনি দেখা! এটাও যেন একটা কল্পনার মতো লাগছে। মনে মনে কত কথা সাজিয়েছিল লুবনা কিন্তু এখন সব গুলিয়ে যাচ্ছে কেন! কি বলবে বুঝে উঠতে পারছেনা। মনের ভিতর একটু সাহস যুগিয়ে ধীরে ধীরে ফয়সালের পিছনে এসে দাঁড়িয়ে কিঞ্চিত নিচুগলায় “আপনি কি ফয়-- কথাটা শেষ না হতেই লোকটি পাশ ফিরে, লুবনার দিকে তাকায়, তারপর এক গাল হেসে উত্তর দেয়, “হ্যা, আমিই তোমার সেই কাঙ্ক্ষিত ফয়সাল।”

ফয়সালের দিকে দৃষ্টি পরতেই, লুবনার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। এটা সে কাকে দেখছে! কিছুতেই যেন বিশ্বাস করতে পারছেনা যে এটা তার সেই স্বপ্নের রাজপুত্র ফয়সাল! কিছুতেই মেলাতে পারছেনা! এটা কি করে সম্ভব? বুঝতে তার আর বাকী রইলোনা, প্রোফাইল পিকচারটা ফয়সালের তরুন বয়সের। অতি কষ্টে নিজেকে সংবরণ করে পাশে গিয়ে বসে লুবনা। কিছুক্ষণ কথোপকথনে জানতে পারলো, ফয়সাল বিবাহিত, দুই সন্তানের জনক এবং বড় মেয়েটি কলেজগামী। বাবার মতো অর্ধবয়সী একটি লোক এতো বড় চিটার, এতো বড় ধোকাবাঁজ! এই বয়সে নিজের মেয়ের বয়সী আরেকটি মেয়ের, কতো বড় সর্বনাশই না সে করেছে! রাগে, ক্ষোভে লুবনার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল, ইচ্ছে করছিল ফয়সালের মুখে শক্ত করে কষে একটি চড় বসিয়ে দিতে। কিন্তু এটাও যেন তার রুচিতে বাঁধছিল। লজ্জায়, ঘৃণায় কোনো কথাই লুবনার মুখে আসছে না। দাঁতে দাঁত চেপে, হাতের মুঠি দুটো শক্ত করে ধরে উঠে দাড়ায় লুবনা। ছিঃ! এটা সে কি করেছে! এতদিন বাবার বয়সী একটি বুড়ো লোকের সাথে---আর যেন ভাবতে পারছেনা লুবনা। নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারালো! পেছনের দুটি বছর নিজের হাতে নিজেই--- কতো বড় ক্ষতি করে ফেললো, এ ক্ষতি পূরণ হবার নয়! যেন দুটি বছর জীবন থেকে হারিয়ে ফেলা। দীর্ঘ একটি বড় নিঃশ্বাস ছাড়ে লুবনা, অজান্তেই ঠোটে ফুটে উঠে বক্রহাসি, নিজেকে ধিক্কার দিয়ে বলে, এতোটা বোকা মেয়ে আমি! এতো বড় ভুল! কি করে করলাম! কি করে??


মাথাটা তখনো ঘুরপাক খাচ্ছিল লুবনার, আস্তে আস্তে পিছনের দিকে পা বাড়ায়, ফয়সালের নামটা চিরতরে ব্লক করে দিবে, ফেসবুক লিস্ট থেকে আর ঘৃণাভরে জীবন থেকেও....।


আর ফয়সালরা?? আবার নতুন অন্য কোন লুবনার ফেসবুক ওয়ালে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্টে বোতাম টিপবে, সর্বনাশার হাত বাড়িয়ে!!

সর্বশেষ সংবাদ

গদ্য এর আরও সংবাদ