মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আঠারো ঘন্টা


ই-বার্তা প্রকাশিত: ২৬শে নভেম্বর ২০১৭, রবিবার  | বিকাল ০৫:৪৪ বিশেষ প্রতিবেদন

ই-বার্তা ।। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের কয়েকটি গ্রাম সম্প্রতি ঘুরে এসেছেন এএসএম সুজা উদ্দিন। সেখানে তিনি প্রায় ১৮ ঘণ্টা অবস্থান করেন। তিনি এখন পর্যন্ত বিশ্বের সর্বশেষ সংবাদকর্মী, যিনি রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর আক্রমণে ধ্বংস হয়ে যাওয়া গ্রামগুলো পর্যবেক্ষণ করেছেন।

গণহত্যা কিভাবে চালানো হয় সেটি এখনো ঘটনাস্থল পর্যবেক্ষণ করে জানাতে পারেনি কেউ। এটি অবশ্য মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও মগদের বাধার মুখে সম্ভব হচ্ছে না। সেই বাধার গণ্ডি পেরিয়ে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুজতেই রাখাইন পরিদর্শনে একাই (সাংবাদিক হিসেবে) যান সুজা উদ্দিন। তিনি ২০ নভেম্বর মিয়ানমারের উদ্দেশ্য যাত্রা শুরু করেন। সেখানে তিনি সর্বসাকুল্যে ১৮ ঘণ্টা অবস্থান করতে সক্ষম হন।


ইঞ্জিন নয়, হাতে বৈঠা টানা নৌকায় দুই মাঝিসহ আমরা তিনজন। নৌকা ছাড়ার আগেই পোশাক পরিবর্তন করি, যাতে কেউ দেখলে মাঝি মনে করে। উজানে নৌকা চালিয়ে রাত ৩ টায় কাঁটাতার পার হয়ে মিয়ানমারে ‘কোয়াংচিবং’ এলাকায় পৌছাই। বলেন সুজা উদ্দিন।

এএসএম সুজা উদ্দিন এই প্রতিবেদককে বলেন, কুতুপালং কাস্টম থেকে একটু দূরে লম্বাবিল টেংখালি খালে ‘ঢেউবুইন্যা ব্রীজ’ থেকে যাত্রা শুরু। সোমবার (২০ নভেম্বর) রাত ৯:৩০টা । তিন ঘণ্টা নৌকায়। মাঝ পথে কিছু সময় নদীতে সুজানের (ভাটির) জন্য অপেক্ষা। রাত আড়াইটার সময় রাখাইনের ‘কোয়াংচিবং’ গ্রামে পা রাখি। মোট সাড়ে নয় ঘণ্টা রাখাইন রাজ্যে থাকার পর ‘কোয়াংচিবং’ পাড়ার বক্করের বাড়ির পাশ দিয়ে পরদিন দুপুর ১টার সময় কাঁটাতার পার হয়ে বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা করি। বিকেল চারটায় কাস্টমের ‘ঢেউবুইন্যা ব্রীজে’ ফিরে আসি। মোট সাড়ে আঠারো ঘণ্টা জার্নির সাড়ে নয় ঘণ্টা রাখাইন রাজ্যের ‘কোয়াংচিবং’ গ্রামের অন্তত আট’শ ঘর দেখার সুযোগ হয়। মগদের উপস্থিতি টের পাচ্ছিলাম আর ক্যামেরার চার্জ শেষ হয়ে গিয়েছিল। তাই দ্রুত ফিরতে হয়েছে।

তিনি জানান, টেকনিক্যাল সাপোর্টের জন্য খুব কম দৃশ্যই ক্যামেরায় ধারণ করা সম্ভব হয়েছে। তবুও অন্তত এক ঘণ্টার ভিডিও ধারণ করা সম্ভব হয়েছে। ছবি (স্টিল পিকচার) তোলা সম্ভব হয়েছে অনেকগুলো। সেখানে কাঁটাতারের পাশে ল্যান্ড মাইনের ভয় সাথে থাকা রোহিঙ্গাদের আধামরা করেছিল। ১৮ ঘণ্টার এই সময় প্রত্যেকটা মুহুর্ত কেটেছে ভয় আর মৃত্যুকে হাতে নিয়ে।

তিনি বলেন, ‘আরো কিছু সময় অবস্থান করার ইচ্ছে ছিল। তবে মগদের উপস্থিতি টের পেয়েছিলাম। ভয় বেড়ে গেল। তখন দ্রুত কাঁটাতার পার হয়ে বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা হই। এসময় শরীরের বিভিন্ন অংশে কাঁটাতারের আঘাতে কেটে যায়। তখন আমরা গুলির শব্দ শুনতে পাই। ভয় এবার দ্বিগুণ বেড়ে যায়। পানি সাঁতরিয়ে কাঁটাযুক্ত পথে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে নৌকায় উঠি।

আরাকানের এই মাদ্রাসাটি পুরো ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। সেখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে সুজা উদ্দিন বলেন, সেখানকার ঘরগুলো দেখে বোঝা যাচ্ছিল যে হাত দিয়ে কিংবা মশাল দিয়ে এই ঘরগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়নি। ওপর থেকে রকেট কিংবা বোম ফেলে রোহিঙ্গা হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে। পুরো এলাকায় অন্তত আট হাজারের মতো ঘরের ধ্বংসবশেষ রয়েছে। ‘কোয়াংচিবং’ এর পুরনো মাদ্রাসার পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এটি রোহিঙ্গাদের সমুলে ধংশ করার চেষ্টার একটি প্রমাণ হতে পারে। সেখানে ছোট উঁচু একটি যায়গায় সব ঠিক আছে কিন্তু ঘর নেই, শুধু ছাই দেখা যায়। এটা থেকে বোঝা যায় কিভাবে টার্গেট করে হামলা করা হয়েছিল।

সুজাউদ্দিন বলেন, মাঝে মাঝে কিছু ঘরে বিছানা পাতানো, এলোমেলো ভাবে পড়ে আছে কাপড়, মেয়েদের বিভিন্ন জামা, অন্তর্বাস ইত্যাদি। এগুলো গণধর্ষণের চিহ্ন বহন করে। সাথে থাকা এক রোহিঙ্গা আমাকে (সুজা উদ্দিনকে) বলেন, “এটা আলিমের ঘর, সে এখন বালুখালী ক্যাম্পে থাকে। এই ঘরে গণধর্ষণ করা হয়েছে।” কিছুটা এগিয়ে গেলে একটা ঘরে দেখতে পাই অনেকগুলো মোবাইলের ভাঙ্গা অংশ। এটা দেখে বোঝা যায় যে এখানে আলকিনের (রোহিঙ্গা বিদ্রোহী) লোকজন ছিল এবং পরবর্তীতে জিজ্ঞেস করে সত্যতা যাচাই করি।

সর্বশেষ সংবাদ

বিশেষ প্রতিবেদন এর আরও সংবাদ