‘কলেজ পাশ করতে পারিনি তবু আমি সফল’


ই-বার্তা প্রকাশিত: ৮ই মে ২০১৭, সোমবার  | রাত ০৯:৫৯ দেশ

তারিকুল হাসান

সাভার থানার ভাকুরটা ইউনিয়নের লুটের চড় গ্রামের হাবিবুর রহমানের দীর্ঘদিনের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের ফসল হাজী ডেইরী ফার্ম।সফলতার মুখ দেখার জন্য ১৩ বছর কঠিন ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়েছেন তিনি। বিদেশে না গিয়ে দেশের মাটিতে বসে যে খুব ভাল আয় করা সম্ভব তারই প্রমাণ দিয়েছেন আত্মবিশ্বাসী এই উদ্যোক্তা ।

দেশের মাটিতে গাভী পালন করে দেখিয়ে দিয়েছেন তার সফলতা। পাঁচটা গাভী দিয়ে শুরু করে, এখন তার ফার্মে গাভীর সংখ্যা ৫০ টা। যার বর্তমান বাজাড় মূল্য প্রায় দেড় কোটি টাকা। প্রতিদিন তার দুগ্ধ খামার থেকে উৎপাদন হচ্ছে ২০০ লিটার দুধ, যার বাজাড় মূল্য ১২ হাজার টাকা। অর্থাৎ শুধু দুধ বাজারজাত করে প্রতি মাসে তার আয় হয় ৩ লখ ৬০ হাজার টাকা এবং বছরে ৪৩ লখ ২০ হাজার টাকা।

বেশী দূর পড়াশুনা করতে পারেননি হাবীবুর রহমান। এস এস সি পাশ করলেও কলেজে পড়াশুনা করার ভাগ্য হয়নি তার । আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে পাড়ি জমাতে হয় সুদূর ইতালির পিৎজা শহরে।
১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯৫ সাল প্রযন্ত ইতালিতে কাটান তিনি। ইতালির রোম, বাড়ি, পিৎজা শহরে শ্রমিকের কাজ করতেন তিনি। হাবিবুর রহমান বলেন, ‘ইতালিতে পিৎজা শহরে থাকতাম। ভ্যাড়া পালতাম। আমি আর একটা কুকুর মিলে ৭৩০ টা ভ্যাড়া দেখাশুনা করতাম। প্রচণ্ড তুষাড় পড়ত, শীতে আমি কাবু হয়ে যেতাম।
‘চার বছর আমি ইতালিতে কষ্ট করেছি। সেই কষ্ট থেকে ফিল করলাম, আমিদেশে গিয়ে এর থেকে ভাল কিছু করতে পারি। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি ইতালি ছাড়বো, ঢাকা ছাড়বো, গ্রামে যাবো।’

কিন্তু দেশে ফিরে সামান্য পুঁজি নিয়ে গ্রামে তেমন কিছুই করতে পারেননি হাবিবুর। দীর্ঘ ৮ বছর মোহাম্মাদপুর কৃষি মার্কেটের খেলনার ব্যবসা করলেও তার মন গিয়ে পরে থাকত গ্রামে।
বিদেশে জমানো কিছু মূলধন, পরিবারের সাহায্য আর খেলনার ব্যবসার মোট ৯ লক্ষ টাকা নিয়ে ২০০৪ সালে লুটেরচড় গ্রামে বাবা ফজলুল হকের নিজস্ব জায়গায় পাঁচটা গাভী দিয়ে শুরু করেন গাভী পালন। গাভীর নিবিড় পরিচর্যার জন্য সংসার ছেড়ে বসবাস শুরু করেন খামার বাড়িতে। বিভিন্ন বাধা আসলেও তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যান তিনি। দিন-রাত পরিশ্রমের ফল হিসাবে ধীরে ধীরে হাবিবুর রহমানের খামারে বাড়তে থাকে গাভীর সংখ্যা।

হাবিবুর রহমান এরপর ব্রাক ব্যাংক থেকে ১৭% সুদে ঋণ নেন। গাভীর সংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি বাড়তে থাকে তার ঋণের পরিমাণও। ব্র্যাক ব্যাংক থেকে তিন লাখ, পাঁচ লাখ, সাত লাখ, নয় লাখ, দশ লাখ এরকম পর্যায়ক্রমে মার্কেন্টাইল ব্যাংক থেকে ১১% সুদে ২০ লাখ টাকা ঋণ নেন তিনি। খামারে উৎপাদিত দুধ বিক্রি করে পরিশোধ করেছেন ব্যাংকের ঋণের টাকা। বিক্রির পাশাপাশি তার বাড়িতে, আত্মীয়স্বজনদের পাঠিয়েছেন নিজের খামারের দুধ।
নানাজন নানা কটু কথা বললেও হাল ছাড়েননি হাবিবুর। নিজের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন তার দুগ্ধ খামার। বাবা ফজলুল হকের নামে নামকরণ করেছেন খামারের,হাজী ফজলুল হক ডেইরী ফার্ম।
সংকর, শাহিয়াল, অস্ট্রেলিয়ান, ক্রস সহ বিভিন্ন জাতের গাভী আছে তার খামারে। প্রতিটি গাভী প্রতিদিন ২০ থেকে ২৮ লিটার দুধ দেয়। ২০ লিটার এর নিচে দুধ দিলে সেই গাভী বিক্রি করে দেন হাবিবুর। তার খামারেব গাভী ও বাছুর পরিচর্যা, দুধ দোহন এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য কর্মসংস্থান হয়েছে আর ছয় জন বেকার মানুষের। দুগ্ধ খামারে কাজ করে, সুন্দর জীবন -যাপন করছেন তারা ।

হাবিবুরের খামারের দুধ বিক্রি করতে বাজারে আসতে হয়না। রাজধানীর কিছু মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের লোকজন চলে যান তার খামারে, গরুর খাঁটি দুধ কিনে নিয়ে যায় সেখান থেকে। তার খামারের দুধের মান ভাল হওয়ায় চাহিদা থাকে সবসময়।

গাভী পালনের জন্য কোন প্রশিক্ষণ নিয়েছেন কিনা জানতে চাইলে হাবিবুর রহমান বলেন, ‘ইতালিতে ভ্যারা পালার সময় ভাল একটা অভিজ্ঞতা হইছে আমার, তাছাড়া তেমন কোন প্রশিক্ষণ নাই। দেখে দেখে শিকছি সব। এলাকার পশু ডাক্তার ফারুক যখন আসত বলত, ভাই শিইখ্যা নেন কেমনে কি করতে হয়।আমি তো আর সব সময় থাকুম না। তখন খুব মনযোগ দিয়ে খেয়াল করতাম ওর কাজ।

এখন ডেলিভারি থেকে শুরু করে ভ্যাকসিন দেয়া, পরিচর্যা, খাবার-দাবার কখন কি দিতে হবে নিজেই বুঝি। আর বড় কোন সমস্যা হলে ডাক্তারকে ফোন করলে সাথে সাথে চলে আসে।’

খামারের পিছনে এখন ১০ বিঘা জমি করেছেন হাবিবুর। সেই জমিতে চাষ করছেন ইন্ডিয়ান হাইব্রিড জাম্বোজাতের ঘাস।জমির সেইকাঁচা ঘাস খাওয়ান গাভীকে। এছাড়া গম ও ভুট্টার ভুষি, চাউলের কুড়া, খুদ, খড়কুটা, ব্রান, খেঁসারি, মসুরি, বুটের ছোলা, খৈল, পরিস্কার পানিসহ অধিক দুধের জন্য নিয়ম মেনে সুষম খাদ্য খাওয়ান গাভীকে।

গাভীর গোবর দিয়ে খামারে তৈরি করছেন বায়োগ্যাস। এই গ্যাস ব্যবহার করে খামারে রান্না-বান্না সহ বিভিন্ন কাজ করছেন খামারিরা।

কথা হয় হাজী ডেইরী ফার্মে পাবনা থেকে আসা শ্রমিক মনসুরের সাথে। তিনি বলেন, ‘খামারে ৯ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করি। খাওয়া-দাওয়া মালিকের। এখানে গরুর দেখাশুনা করি। থাকার ব্যাবস্তা মালিক-ই করে দিছে। আমি সহ আরও পাঁচ জন আছি। মালিক ভাল, খাবার-দাবার এর মানও ভাল, এখানে থাকতে আমদের কোন সমস্যা হয় না।’

এখন গাভী পালনের সাথে সাথে গাভী কেনাবেচাও করছেন হাবিবুর। কোরবানি ঈদ কে সামনে রেখে প্রতিবারের মত এবার কিনছেন কিছু গাভী, যেগুলো কয়েকমাস পালনের পরে বেশি দাম বিক্রি করে দিবেন ঈদের বাজারে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জানতে চাইলে হাবিবুর রহমান বলেন, ‘আমি এস এস সি পাশ করছি কিন্তু কলেজ পাশ করিনি। তারপরেও আমি এখন সফল। সত্যি কথা বলতে কি, ব্যাপক ধৈর্য আর সততার সাথে কাজ করলে সফলতা আসবেই।ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বলতে ছেলে-মেয়েদের মানুষের মত মানুষ করা যেন আমার মতো তাদের কষ্ট করতে না হয়।

‘খামারে দুধ প্যাকেটজাত করে বাজারজাতকরণের চিন্তা করছি, পরীক্ষামূলকভাবে কিছু বাজারে ছেড়েছিলাম সেগুলো ভাল মার্কেট পেয়েছে। মিষ্টির কারখানা করার পরিকল্পনা আছে। নিজের খামারের খাঁটি দুধ দিয়ে মিষ্টি সহ দুধের বিভিন্ন আইটেম তৈরি করে, স্বল্প মূল্যে শহরবাসীর কাছে পৌঁছে দেয়ার ইচ্ছে আমার।’

কাউকে বেকার না থাকতে বলে তিনি জানান, দুই টা গরু দিয়ে হলেও শুরু করেন, বেকার বসে থাকবেন না। ২৪ ঘণ্টা ফোকাসটা গরুর দিকে রাখলে আপনার উন্নতি নিশ্চিত।
এস এম ই ফাউন্ডেশন এর ব্যাপারে কিছু জানেন কিনা এবং এই এস এম ই ফাউন্ডেশন এর পক্ষ থেকে গাভী পালনে কোন সাহায্য, সহযোগিতা পেয়েছেন কিনা জানতে চাইলে হাবিবুর রহমান বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমার কোন ধারণা নাই। আর তারা আমাকে কোন সাহায্য, সহযোগিতা করেনি।’

সর্বশেষ সংবাদ

দেশ এর আরও সংবাদ