শেষ হলো কঠিন চীবর দানোৎসব


ই-বার্তা প্রকাশিত: ৩রা নভেম্বর ২০১৭, শুক্রবার  | সন্ধ্যা ০৬:৩২ বিশেষ প্রতিবেদন

জিয়াউল হক, রাঙামাটি॥

রাঙামাটি রাজবন বিহারে দু’দিনব্যাপী ৪৪ তম দানোত্তম কঠিন চীবর দানোৎসব সম্পন্ন হয়েছে। বৃহস্পতিবার বেইনঘর উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় এই উৎসব। এটি পার্বত্যাঞ্চলে বৌদ্ধদের বৃহত্তম কঠিন চীবর দানোৎসব।

শুক্রবার দুপুরে গৌতম বুদ্ধ ও বনভান্তের প্রতিকৃতিতে চীবর দান ও দেশনার মাধ্যমে শেষ হয় এবারের দানোৎসবের আনুষ্ঠানিকতা। সন্ধ্যায় আকাশ প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করা হয়। এ দানোৎসবে প্রায় লক্ষাধিক লোকের সমাগম হয় প্রতি বছরই।

এর আগে দানোৎসব উপলক্ষে বৃহস্পতিবার বেইন কর্মীদের পঞ্চশীল গ্রহণের মধ্য দিয়ে বেইনঘর উদ্বোধন করেন চাকমা রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়। পরে চরকায় সুতা কেটে অনুষ্ঠানের সূচনা করেন। এ বছর রাজবন বিহারে ১৩০টি বেইনে অন্তত ৫২০ জন মহিলা কর্মী অংশগ্রহণ করে। এছাড়া সুতা লাঙ্গানো, সিদ্ধ, রং, টিয়ানো, শুকানো, তুম করা, নলী করা, বেইন টানার কাজে আরো শতাধিক পুরুষ কর্মী অংশগ্রহণ করে। শুক্রবার সকাল ৬টা থেকে শুরু করে দুপুুর ১২টা পর্যন্ত চীবর সেলাই শেষে চীবর দান করা হয়। এসময় ‘সাধু’ ‘সাধু’ ধ্বনিতে মুখরিত হয় পুরো রাজবন বিহার। বৃহস্পতিবার রাতব্যাপী কঠিন চীবর প্রস্তুত করে শুক্রবার বেলা আড়াইটায় রাঙামাটি রাজবন বিহারের আবাসিক প্রধান প্রজ্ঞালঙ্কার মহাস্থবিরের হাতে কঠিন চীবরটি তুলে দিয়ে ভিক্ষুসংঘকে দান করেন চাকমা রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়।

শুক্রবার সকাল ছয়টায় বুদ্ধ পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে দিনের কার্যক্রম শুরু হয়। সকাল ১০টায় অনুষ্ঠিত হয় দেব-মানবের তথা সকল প্রাণীর হিতার্থে ধর্মদেশনা। ধর্মদেশনায় উপস্থিত ছিলেন রাজবন বিহারের আবাসিক প্রধান শ্র্রীমৎ প্রজ্ঞালঙ্কার মহাস্থবির। এসময় উপস্থিত ছিলেন চাকমা সার্কেল চিফ ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়, রানী ইয়েন ইয়েন, উপাসক-উপাসিকা পরিষদের সহ-সভাপতি গৌতম দেওয়ানসহ অন্যান্য পুণ্যার্থীরা।

চীবর তৈরির পর শুক্রবার দুপুর দুইটায় শোভাযাত্রা সহকারে কঠিন চীবর ও কল্পতরু মঞ্চে আনা হয়। পঞ্চশীল গ্রহণের পর দুপুর আড়াইটায় বনভান্তের মানব প্রতিকৃতির উদ্দেশ্যে কঠিন চীবর উৎসর্গ


করা হয়েছে। এসময় বনভান্তের প্রতিনিধি হিসেবে এ চীবর গ্রহণ করবেন আবাসিক প্রতিনিধি শ্রীমৎ প্রজ্ঞালঙ্কার মহাস্থবির।

চীবর দানে শ্রীমৎ প্রজ্ঞালষ্কার মহাস্থবির বলেন, বৌদ্ধ ধর্ম সকলের শান্তি কামনা করে। এইবার বাংলাদেশ সহ সারা বিশ্বের শান্তির জন্য প্রার্থন া করা হয়েছে বলেও তিনি জানান।

গৌতম বুদ্ধের জীবদ্দশায় মহাউপাসিকা বিশাখা ২৪ঘন্টার মধ্যে তুলা থেকে সুতা এবং সুতা রং করে কাপড় বুনে তা সেলাই করে চীবর (ভিক্ষুদের পরিধেয় বস্ত্র) দান করে এই কঠিন চীবরদানের সুচনা করেন আড়াই হাজার বছর আগে। এই পদ্ধতিতে দান করলে কায়িক, বাচনিক মানসিকভাবে অধিক পরিশ্রম হয় এবং অধিকতর পুণ্যলাভ হয় বলে বৌদ্ধ শাস্ত্রে উল্লেখ আছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে সর্বোচ্চ বৌদ্ধ ধর্মীয় গুরু সাধনানন্দ মহাস্থবির (বনভান্তে) ১৯৭৪ সালে রাঙামাটি জেলার লংগদু উপজেলার তিনটিলা বন বিহারের দায়ক-দায়িকাদের দিয়ে এই কঠিন চীবর দানোৎসবের পুনঃ প্রবর্তন করান।

চীবন দান অনুষ্ঠানে রাজবন বিহারের প্রধান পৃষ্ঠপোষক চাকমা সার্কেল চিফ ব্যারিষ্টার রাজা দেবাশীষ রায়, চাকমা রানী ইয়েন ইয়েন, জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মানজারুল মান্নান, পুলিশ সুপার সাঈদ তারিকুল হাসান, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বৃষ কেতু চাকমা, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদর জোন কমান্ডার রেদওয়ানুল হক সহ জেলার উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
রাজবন বিহারের প্রধান পৃষ্ঠপোষক চাকমা সার্কেল চিফ ব্যারিষ্টার রাজা দেবাশীষ রায় বলেন, কঠিন চীবর দান একটি মহৎ দান। এই দানের মধ্যে দিয়ে ভিক্ষু ও পূর্নার্থীদের মিলন মেলায় রূপ নেয়। এই দান অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলে সাম্প্রাদায়িক সম্প্রতি বিরাজ থাকবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

রাঙামাটি রাজবন বিহারে সর্বপ্রথম কঠিন চীবর দান অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৭ সালে। সেই থেকে প্রত্যেক বছর রাঙামাটি রাজবন বিহারসহ পার্বত্য তিন জেলার রাজবন বিহারের শাখাসমূহে বিশাখা প্রবর্তিত নিয়মে কঠিন চীবর দানোৎসব সম্পাদন করা হয়ে থাকে।

সর্বশেষ সংবাদ

বিশেষ প্রতিবেদন এর আরও সংবাদ